জাতীয় রাজনীতিতে নীরব, স্থানীয়তে সরব জামায়াত

জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে নীরব ভূমিকায় রয়েছে ২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় শরিক জামায়াতে ইসলামী। শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিতে আগের মতো যেমন রাজপথের আন্দোলনে নেই দলটি, তেমনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেও ঢিলেঢালা অবস্থান তাদের। এমনকি বিএনপি জোটে থাকা না থাকা কিংবা জোট থেকে বের করে দেওয়ার প্রশ্নেও রহস্যজনক নীরবতায় দলটি। তবে, জাতীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় দেখা গেলেও আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে আলোচিত-সমালোচিত এ দলটির নেতাকর্মীরা।

মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ ১০ নেতার অধিকাংশই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও হয়েছে। বাকিরা আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায়। অন্যদিকে সরকারবিরোধী ও শীর্ষ নেতাদের মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রথম থেকে তৃতীয় সারির নেতাদেরও বেশীরভাগ কারাগারে বা আত্মগোপনে। জামায়াতের নিবন্ধনও হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। নেতাদের পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াত বিচারের মুখোমুখি রয়েছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত রাজনৈতিক চাপে রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের রক্ষায় টানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে মাঠে সরব ছিল জামায়াত। কিন্তু চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০ দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার ডাকা টানা তিন মাসের অবরোধ কর্মসূচিতে দলটির নেতাকর্মীরা যেমন নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তেমনি গত তিন মাস ধরে ‘কর্মসূচিহীন’ ২০ দলের জোটে জামায়াতের থাকা না থাকা কিংবা তাদের রাখা না রাখার প্রশ্নেও রহস্যজনক নীরবতা পালন করছেন নেতারা।

বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিএনপি জোটে জামায়াতকে না রাখা কিংবা জোট ভেঙ্গে দিতে খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছেন। এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় খালেদা জিয়া তার সঙ্গে দেখা করে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে আলাদাভাবে ১৫ মিনিট একান্তে কথা বলেছেন। বৈঠকে মোদি খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জাতীয় রাজনীতিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ নিয়ে জামায়াতও ক্ষুব্ধ এবং বিব্রত বলে জানা গেছে। তবে কৌশলগত কারণে এখানেও নীরব রয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।

বিএনপির অতি জামায়াত নির্ভরতা এবং জিয়ার আদর্শে ফিরে আসতে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে শুক্রবার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বি চৌধুরী বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ২০ দলীয় জোটের শরিক সকল দলেরই নিজস্ব আদর্শ ও কর্মসূচি রয়েছে। কাজেই এখানে এক দলের ওপর অন্য দলের নির্ভরশীলতার প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর। ২০ দলীয় জোট একসঙ্গে কর্মসূচি ঘোষণা করছে এবং তা পালন করছে। ২০ দলীয় জোটের শরিক কোনো দলকে অপর দলের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ প্রদান মূলত জোট ভাঙ্গারই পরামর্শ। এ পরামর্শ দিয়ে বি. চৌধুরী কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান?

জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, জাতীয় রাজনীতিতে যা কিছু হচ্ছে সবই পর্যবেক্ষণে রেখেছে জামায়াত। তবে, কৌশলগত কারণেই নীরব রয়েছে দলটি। সেক্ষেত্রে আগামী বছরের (২০১৬) শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতিতে সরব রয়েছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

জামায়াত সূত্র জানায়, চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ভাল ফলাফল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আশা যুগিয়েছে। ওই নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত ৩৬ জন উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রায় পৌনে দুই শ’ ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা থাকা অবস্থায়ই বিপুলসংখ্যক দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ে আশান্বিত হয়ে ওঠে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

ওই সময় জামায়াতের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান একাধিক বিবৃতিতে উপজেলা নির্বাচনে তাদের সাফল্যকে সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিপরীতে জনগণের জবাব বলে অভিহিত করেন।

সূত্র জানায়, গত উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে ও সেখানে নিজেদের নানা ত্রুটিপূর্ণ দিক পর্যালোচনা করে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। সেক্ষেত্রে শুধু দলের বড় নেতাই নন, যিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন বা থাকতে পারেন এমন প্রার্থীদেরই নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ করার পরামর্শ কেন্দ্রীয় জামায়াতের।

জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান গত মে মাসের মাঝামাঝিতে জেলা ও মহানগর আমিরদের উদ্দেশে আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ নিয়ে চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে তিনি দিকনির্দেশনামূলক ও করণীয়গুলো অনেক বিষয় স্থানীয় নেতাদের বাতলিয়ে দেন। তার উল্লেখযোগ্য দিক হল—

(১) জেলার সকল পৌরসভায় পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান ও মেম্বর পদে প্রার্থী ঠিক করে এখন থেকেই তাদের মাঠে-ময়দানে তৎপর করে তোলা।

(২) যে সকল পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে, সে সকল এলাকায় এখন থেকেই ‘নির্বাচনী গাইড’ (দিকনির্দেশনা) অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া।

(৩) আগামী আগস্ট মাস থেকে প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রের পরিচালক ও প্রধান পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

(৪) ‘ভোট ডাকাতি’ মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং ছাত্র ও শ্রমিকসহ (জামায়াত-শিবির) ৫০-৭০ জনের সাংগঠনিক কর্মী গড়ে তোলা। নির্বাচনের দিন দেড় শ’ থেকে দুই শ’ ভোটকর্মী কেন্দ্রে উপস্থিত রাখার চেষ্টা করা।

চিঠিতে বলা হয়, “বর্তমানে এই কঠিন সময়ে জনগণের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য নির্বাচনের কাজকেই সর্বোত্তম সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং আগামী রমজান মাসে নির্বাচনী কাজের বেশীরভাগ করে ফেলার চেষ্টা করতে হবে।(স্থানীয় সরকার নির্বাচনে) সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে এখন থেকেই ‘নির্বাচনী জিহাদে’ ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।”

ডা. শফিকুর রহমান চিঠিতে আরও বলেন, ‘আগামী ১৯ জুন থেকে রমজান শুরু হতে পারে। এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে, যে সকল পৌরসভা ও ইউনিয়নে এবং যে সকল ওয়ার্ডে আমরা (জামায়াত) নির্বাচন করতে চাচ্ছি সে সকল এলাকায় ইফতার মাহফিল করতে হবে।’ শুধু তা-ই নয়, এই রমজান মাসেই নির্বাচনী খরচ সংগ্রহেরও দিকনির্দেশনা দেন জামায়াতের এ শীর্ষ নেতা।

কেন্দ্রের দিকনির্দেশনার কথা স্বীকার করে বগুড়া জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা আব্দুল হক বলেন, কেন্দ্রের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বগুড়ায় যে সব এলাকায় সংগঠন শক্তিশালী এবং যোগ্য প্রার্থী রয়েছে সে সব জায়গায় (পৌরসভা-ইউনিয়ন) আমরা প্রার্থী দিচ্ছি। তবে, প্রার্থী তালিকা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

তিনি বলেন, গত উপজেলা নির্বাচনের মতো আগামী পৌরসভা এবং ইউনিয়ন নির্বাচনে পুরুষ প্রার্থীর পাশাপাশি নারী প্রার্থীও দেবে জামায়াত। প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় অবস্থানের পাশাপাশি প্রার্থীর জনপ্রিয়তাও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরাঞ্চলে জামায়াতের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনী মাঠে প্রার্থী একটি বড় ফ্যাক্টর। সংগঠন ছাড়াও প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজে কোনো কোনো প্রার্থী বার বার নির্বাচিত হয়। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা সবদিক দিয়ে যোগ্যজনকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী করছি। অধঃস্তন সংগঠনকে কেন্দ্র থেকে এ ধরনেরই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই