জাতীয় পতাকা যখন জায়নামাজ : সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার ঝড়
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে জায়নামাজ হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ একজন মুসলমান নামাজ আদায় করছেন; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা সমালোচনা। স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে নামাজ আদায়ের সময় তিনি জায়নামাজ হিসেবে পতাকাটি ব্যবহার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একদলের দাবি, এতে জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়েছে। তবে আরেকদলের মতে, জাতীয় পতাকা পবিত্র জায়নামাজের মতো করে ব্যবহৃত করলে পতাকার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে না। তৃতীয় এক দলের মতে, প্রতীকের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে কাঠমোল্লা আর জাতীয়তাবাদীদের কোনো পার্থক্য নেই।
শরদিন্দু চক্রবর্তী নামের এক ফেসবুক একাউন্ট থেকে এ সংক্রান্ত দু’টি ছবি পোস্ট দেয়ার পর শুরু হয় আলোচনা।
ছবির নিচে লিংকন সাহা নামের একজন লিখেছেন, ‘এটা অন্যায়৷ দেশকে অসম্মান করা৷’ মঞ্জুলি কাজী নামের একজন লিখেছেন, ‘জাতীয় পতাকা কখনোই জায়নামাজ হতে পারে না । যে কাজটি করেছেন সে দেশকে অপমান করেছে। বলা যায় না, পাকি পন্থি হতে পারে সে ।
সুমন দত্ত নামের একজন লিখেছেন, অনেকের কাছে আগে ধর্মীয়া পরিচয় তারপর জাতীয় পরিচয়। ধর্মটাকে সবার আগে দেখে এই শ্রেণী। এদের কাছে জাতীয় পতাকা যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে। কিন্ত ধর্মীয় পরিচয় যেকোনো সময় বদলে যায় না।’
তবে অনেকেই পতাকাকে জায়নামাজ হিসেবে ব্যবহারে কোনো সমস্যা দেখছেন না। আহমেদ সোহেল নামে একজন লিখেছেন, ‘একজন একনিষ্ঠ মুসলিমের কাছে জায়নামাজের পবিত্রতা কতো বিশাল তা কোন অমুসলিম বা নাস্তিকের বুঝা কখনওই সম্ভব নয়।
মুলকথা দেখতে কেমন তা নয়, বরং কেমন দেখছে সেটা। এই ব্যাক্তি যদি ভালোবাসে, সম্মান করে এই পতাকা জায়নামাজ হিসেবে ব্যাবহার করে আমি কোন সমস্যা দেখি না ‘ কামরুজ্জামান পরান লিখেছেন, ‘এটা দেশ ও ধর্মকে ভালবাসার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ, এটাকে খাট করে দেখবে তারাই যাদের সব কিছুতেই দোষ খোজার অভ্যাস আছে…’
আলাপে উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশের প্রসঙ্গ। তারা জাতীয় পতাকাকে পোশাক হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে; এমন কিছু চিত্র পোস্ট দেয়ার পর তুষার কান্তি সরকার নামের একজন লিখেছেন, ‘আমেরিকা বা বৃটেনের পতাকার রং বা ছবি দিয়ে তৈরী করা প্যান্টি বা মোজা কিন্তু সেইসব দেশের পতাকা নয়, বরং সেগুলো পরিধেয় বস্ত্র। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে প্রতিটি দেশের জাতীয় পতাকার একটি স্ট্যান্ডার্ড সাইজ থাকে এবং সেই সাইজের উনিশ বিশ হলেও কিন্তু জাতীয় পতাকার অবমাননাই করা হয়।’
এদিকে শামসুল আরেফীন নামের একজন লিখেছেন, ‘গত বছরের মার্চে জাতীয় সঙ্গীতের ”বিশ্বরেকর্ড” ইভেন্টে বাংলাদেশের পতাকা হাজার মানুষের পায়ের নীচে পড়েও কিন্তু কোন মর্যাদা হারায় নাই, কারুর মনে না থাকলে ছবি দেয়া হল । কুকুর বাংলাদেশী সংস্কৃতিতে একেবারে মর্যাদাহীন হলেও এর গায়ে জাতীয় পতাকা জড়ানো হলেও পতাকার সন্মান ঠিক থাকে কিংবা মাথায় পতাকা বেঁধে, হাতে পতাকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশ্য বিশেষ লিংগ দেখালেও পতাকা মর্যাদায় ভরপুর থাকে।’ এ সংক্রান্ত কিছু ছবিও ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন ধর্ম আর জাতীয়তার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেন, ‘জাতীয়তাবাদের মতো গান্ধা জিনিস আর নাই। দুনিয়াটা তো কালা সাদা হলুদ বাদামি সবার। সবাই মিল্যা মিশ্যা থাকো, সবাই সবাইকে ভালোবাসো, তা না, এরে ওরে শত্রু ভাইবা, দুনিয়াটা টুকরা টুকরা কইরা ভাগ কইরা খুঁটি বসাইয়া দিছ, খুঁটির আগায় ত্যানা। ওই ত্যানারেই তো আমরা পতাকা কই। ধর্মের মতো মিছা জিনিস আর কী আছে? মিছা জিনিস চিরকালই গান্ধা জিনিসের সাথে মিশে। মিছাতে আর গান্ধাতে মিইলা আসমানের আল্লারে ডাকুক, যত পারে ডাকুক, তাতে তোমার কী আর আমার কী!’
তবে বিষয়টিকে গভীরভাবে দেখতে আগ্রহী ব্লগার প্রাবন্ধিক পারভেজ আলম। তাঁর মন্তব্য, ‘প্রতিক নিয়া এহেন প্রতিক্রিয়াশীলতা মৌলবাদী মুসলমানদের দেখানের কথা। সেকুলার জাতীয়তাবাদীরা এমন প্রতিক্রিয়াশীল কেনো হইবেন? এখন প্রতিক্রিয়াশীলতার সময়, তা প্রায় সবাই কম বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হইতেই পারেন। কিন্তু এইটা যে বিচার বিবেচনাহীন কাঠমোল্লা কিসিমের প্রতিক্রিয়াশীলতা, সেইটা জানা থাকা দরকার।’
মন্তব্য চালু নেই