বাংলার জনপ্রিয় সেই নায়িকারা কে কোথায়?

বাংলা চলচ্চিত্রের বয়স ৬ দশকের কাছাকাছি । এই ৬ দশকের মাঝে দীর্ঘ সাড়ে ৪ দশক ছিল অনেক জমকালো । গত এক দশকে বাংলা চলচ্চিত্র সেই জমকালো হারিয়ে আজ জীর্ণ শীর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যা দেখলে খুব কষ্ট হয় । অথচ একদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল চারিদিকে লোকেলোকারণ্য ও কর্ম চাঞ্চল্য । যা আজ শুধুই স্মৃতি । আজ আপনাদের সেই সোনালি যুগের নায়িকাদের নিয়ে কিছু গল্প বলবো যারা আজ সবই স্মৃতি হয়ে আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাই করে নিয়েছেন । কেউবা হয়েছেন গত , কেউবা বেঁচে থাকলেও পর্দায় নেই । অনেকে হয়েছেন কিংবদন্তী আবার অনেকে এক ঝলক আলো ছড়িয়ে হারিয়ে গেছেন ।

১৯৫৬ সালে প্রয়াত আব্দুল জব্বার এর ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয় । ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে আব্দুল জব্বার ছিলেন নায়ক । সেই ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ইতিহাস হয়ে যান রঙ্গনাট্য দলের অভিনেত্রী পূনির্মা সেনগুপ্তা। সেই সময়ের সামাজিক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সহনায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী জহরত আরা এবং ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী পিয়ারী বেগম ওরফে নাজমা। তিনজনেই হয়ে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের কালের সাক্ষী এবং ঠাই করে নিয়েছেন ইতিহাসে । সেই তিনজন দিয়েই শুরু নায়িকা ও সহনায়িকা অথবা অভিনেত্রীর পথচলা । ১৯৫৭ সালে গঠিত হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা। এরপর দৃশ্যপট ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে ।

সুমিতা দেবীঃ ১৯৫৭ সালে পরিচালক ফতেহ লোহানি তাঁর ‘আসিয়া’ ছবির জন্য কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নির্বাচন করেন হেনা ভট্টাচার্য নামের এক হিন্দু Sumita-debi-628x1024পরিবারের তরুণীকে । ফতেহ লোহানি হেনা ভট্টাচার্যের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সুমিতা দেবী। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায় ৬০ সালে । বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম দিকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের কারণে তাঁকে বলা হতো ‘ফার্স্ট লেডি’ এরই মধ্যে সুমিতা দেবীর অভিনীত এহতেশাম পরিচালিত ‘ এ দেশ তোমার আমার’ ছবিটি মুক্তি পায় যা ছিল সুমিতার ২য় চুক্তিবদ্ধ ও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র এর পর মুক্তি পায় ফতেহ লোহানির ‘আকাশ আর মাটি’ ছবিটি । ‘আসিয়া’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে । ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নাম ভূমিকায়। সুমিতা দেবীর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো সোনার কাজল (১৯৬২, নায়ক খলিল), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩, নায়ক আনোয়ার হোসেন), এই তো জীবন (১৯৬৪, নায়ক রহমান), দুই দিগন্ত (১৯৬৪, নায়ক আনোয়ার হোসেন), ধূপ ছাঁও (১৯৬৪, নায়ক এজাজ), জনম জনম কি পিয়াসি (১৯৬৮), সঙ্গম (১৯৬৩, নায়ক খলিল), অশান্ত প্রেম (১৯৬৮, নায়ক হায়দার শফী)। উল্লেখ্য যে ‘ধূপ ছাও’ (উর্দু) তাঁর নায়ক এজাজ ছিলেন গায়িকা নুরজাহানের স্বামী। এরপর সুমিতা দেবী ১৯৬৭ সাল থেকে নায়িকা বা কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে চলে যান সহ অভিনেত্রী বা মা/খালা/ ভাবি/ বড়বোন চরিত্রগুলোর দিকে ।

সময়ে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সুলতানা জামান, নাসিমা ও রওশন আরা। সুলতানা জামান অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে আছে ‘মাটির পাহাড়’, ‘অনেক দিনের চেনা’, ‘মালা’ প্রভৃতি। নাসিমা খান অভিনয় করেছেন ‘জাগো হুয়া সাবেরা’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘সূর্যøান’, ‘ধারাপাত’ , ‘অর্পন’ প্রভৃতি ছবিতে। রওশন আরা অভিনয় করেন ‘সূর্যøান’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তালাশ’, ‘নদী ও নারী’ ছবিতে। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন সুচন্দা, সুজাতা, শর্মিলী আহমেদ, শবনম। ‘চেনা অচেনা’, ‘অবাঞ্চিত’, ‘প্রতিনিধি’, ‘ধারাপাত’ ও ‘১৩ নয় ফেকু ওস্তাগার লেন প্রভৃতি ছবির নায়িকা ছিলেন সুজাতা। রাজশাহীর মেয়ে মাজেদা মল্লিক চলচ্চিত্রে শর্মিলী আহমেদ নামে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার অভিনীত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘পানছি-বাওড়ি’, ‘আলিঙ্গন’, ‘পলাতক’, ‘আবির্ভাব’, ‘ঠিকানা’, ‘আগুন’ প্রভৃতি। মেধাবী নির্মাতা জহির রায়হানের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন সুচন্দা। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘কাগজের নৌকা’ ছবিতে তিনি প্রথমে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। সেখান থেকেই জহির রায়হানের নজরে পড়েন। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান ‘বেহুলা’ ছবিতে সুচন্দাকে নাম ভূমিকায় কাস্ট করেন। ছবিটা ব্যবসা সফল হয়। ‘বেহুলা’তে অভিনয় করতে গিয়ে সুচন্দার সঙ্গে জহির রায়হানের মন দেয়া-নেয়া শুরু হয় এবং হঠাৎ করেই তারা বিয়ে করেন। এরপর সুচন্দা একে একে ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘আনোয়ারা’ , ‘দুই ভাই’, ‘আয়না’, ‘পিয়াসা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘অশ্র“ দিয়ে লেখা’, ‘প্রতিশোধ’, ‘জীবন সঙ্গিনী’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্তদর্শকনন্দিত জুটি ছিল রাজ্জাক-সুচন্দা ।এছাড়াও সুচন্দা নায়ক খলিল, আজিম, রহমান, আনোয়ার হোসেন, উজ্জ্বলের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে কাজ করেছেন।

শবনমঃ হিন্দু ধর্মালম্বীর মেয়ে নন্দিতা বসাক ঝর্না শিশু শিল্পী হিসেবে ‘আসিয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন । পরে শবনম নামে নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন 25মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে। ১৯৬১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র হারানো দিনের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শবনম। ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র চান্দা ছবির মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান। এ দু’টি ছবিই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

পরবর্তী বছরে তালাশ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ঐ সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। পেশাজীবি মনোভাবের কারণে তিনি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর ) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। তিনি নায়িকা হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে ধ্বস নামার পূর্বে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন। সম্ভবতঃ বিশ্বে তিনিই একমাত্র চলচ্চিত্র অভিনেত্রী যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত তিনটি দশক ধারাবাহিক ও সফলভাবে রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয় করে অগণিত দর্শক-শ্রোতার মন জয় করেছিলেন।

শবনম অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কখনো আসেনি’, ‘আযান’, ‘দর্শন’ , ‘বেগানা’, ‘জোয়ারভাটা’ , ‘নাচঘর’, ‘সন্ধি’, ‘যোগাযোগ’, ‘জুলি’ প্রভৃতি। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রে সক্রিয় ছিলেন। সত্তর দশকে শবনম নায়ক রহমানের সঙ্গে গড়ে তুলেন জনপ্রিয় জুটি।

কবরীঃ বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে মাত্র ১৪ বছর বয়সে । চলচ্চিত্রে আসার 33আগে চট্টগ্রামের এই মিষ্টি মেয়ের আসল নাম ছিল মিনা পাল।

বাংলা ছবির সোনালী সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নায়িকা প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে ‘নবীতুন’ চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেছিলেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

কবরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’ , ‘ময়নামতি’, ‘বাহানা’, ‘চোরাবালি’, ‘মতিমহল’, ‘পরিচয়’, ‘রংবাজ’, ‘দেবদাস’, ‘সুজন সখি’, ‘কলমীলতা’ দুই জীবন , প্রভৃতি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ যাবৎকালের অন্যতম সেরা জুটি ছিল রাজ্জাক-কবরী।

শাবানাঃ বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী শাবানা। সাবলীল অভিনয়ের কারণে অতি অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। দর্শক পর্দায় খাটিঁ বাঙ্গালী রমণীর sabana_yesmin-2ছায়া খুঁজে পায় অভিনেত্রী শাবানার অভিনয়ের মধ্যে। শাবানা নায়িকা চরিত্রে যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ঠিক তেমন মা বা ভাবীর চরিত্রে অভিনয় করে সমান দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে চকোরী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে আগমন ঘটে শাবানার।

শাবানা প্রথম জীবনে উর্দু ছবিই বেশি করতেন।তবে তিনি ১৯৬২ সালে ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম ছোট্ট মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং ১৯৬৩ সালে তিনি উর্দু ‘তালাশ’ ছবিতে নাচের দৃশ্যে অংশ নেন। এরপর তারপর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেন।শাবানার প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস এস প্রোডাকশন।শহর বা গ্রামীণ তরুণী, বধূ, মাতা এবং ভাবীর চরিত্রে দক্ষতার সাথে অভিনয় করে গেছেন শাবানা।১৯৯৭ সালে শাবানা হঠাৎ করেই চলচ্চিত্র-অঙ্গন থেকে বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি আর নতুন কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি।শাবানার উল্লেখ্যযোগ্য ছবি হলো চোকরি, আনাড়ি, সমাধান, জীবনসাথী, মাটির ঘর, লুটেরা, সখি তুমি কার, কেউ কারও নয়, পুত্রবধু, রজনিগন্ধা , দোস্ত দুশমন, ওস্তাদ সাগরেদ, ‘আক্রোশ’, ‘ভাত দে’, অশান্তি, চাপা ডাঙ্গার বউ , দুই পয়সার আলতা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, সারেন্ডার, বিজয়, অন্ধ বিশ্বাস, স্বাক্ষর, সান্ত্বনা, বিদায়, মরনের পরে, অচেনা , মাস্তান রাজা, কালিয়া, লক্ষির সংসার, রক্ত নিশান , গৃহযুদ্ধ, শ্রদ্ধা, স্নেহ ,স্বামী কেন আসামী, বিশ্বনেত্রী, বাংলার নায়ক সহ প্রভৃতি। ঢাকার ছবিতে প্রায় ৩০ বছর ধরে শাবানা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়িকা। শাবানা নাম শুনতেই দর্শকদের উন্মাদনা শুরু হয়ে যেত। শুধুমাত্র শাবানার নামেই হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় লেগে যেত। শাবানার রুপালী জগত থেকে চলে যাওয়ার পরও এখনও হাজারো মানুষ তাকে মনে রেখেছে। নায়িকাদের মধ্য তিনি সর্বাধিক সংখ্যক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ।
ববিতাঃ ষাটের দশকের শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে যশোরের ফরিদা আখতার পপি নামের এক কিশোরীর যার চলচ্চিত্রে নাম  image_103_13574রাখা হয় ‘ববিতা’ । স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সর্বপ্রথম পুরস্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেন অভিনেত্রী সেই কিশোরী ফরিদা আখতার পপি অর্থাৎ ববিতা । ষাটের দশকের শেষ দিকে (১৯৬৮) পরিচালক জহির রায়হান এর ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ ছবির মাধ্যমে ববিতার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয় । পরিচালক জহির রায়হান ছিলেন ববিতার আপন বড় বোন সুচন্দার স্বামী। সেই দুলাভাই জহির রায়হান এর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটলেও প্রথম ছবি ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ পরিচালক জহির রায়হান শেষ করতে পারেননি । এরপর নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত (১৯৬৯) ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে ফারুকের বিপরীতে অভিনয় করেন যা ছিল নায়ক ফারুকের প্রথম অভিনীত ছবি। এই ছবিটিও শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি । এরপর আবারো জহির রায়হান এর ‘সংসার’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান । সেই সুত্রে ববিতার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘সংসার’ ।

টানা ২টি ছবিতে কাজ করেও ছবি মুক্তি না পাওয়ায় ববিতার দুঃখ অবশেষে শেষ হয় জহির রায়হান এর ‘সংসার’ ছবির মাধ্যমে । তবে ‘সংসার’ ছবিতে তিনি নায়ক রাজ্জাক ও নায়িকা সুচন্দার মেয়ের অভিনয় করেন যেখানে টাইটেলে তার নামছিল সুবর্ণা । ১৯৬৯ সালে তিনি নুরুল হক বাচ্চুর পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে প্রথম নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই ছবিতেই তিনি সুবর্ণা নাম বদলে ‘ববিতা’ নাম দিয়ে অভিনয় শুরু করেন । এভাবেই একজন যশোর থেকে আসা ঢাকা গেণ্ডারিয়ায় পরিবারের সাথে বসবাস করা সেই অতি সাধারন কিশোরী পপি হয়ে উঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী ‘ববিতা’। সেই শুরু বাংলা চলচ্চিত্রে একজন ববিতার পথ চলা দর্শকদের মন জয় করে ।

স্বাধীনতার পর একে একে মুক্তি পেলো অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী – (১৯৭২) আলোর মিছিল, বাঁদী থেকে বেগম, ডুমুরের ফুল বসুন্ধরাগোলাপী এখন ট্রেনে, নয়নমনি ,সুন্দরী অনন্ত প্রেম ,লাঠিয়াল ,এক মুঠো ভাত ,আকাঙ্খা, মা। ফকির মজনু শাহ ,সূর্য গ্রহণ , এখনই সময়, কসাই ,জন্ম থেকে জ্বলছি ,বড় বাড়ির মেয়ে , পেনশন সহ সব কালজয়ী ছবি যা দর্শকদের হৃদয়ে গেথে থাকবে সারা জীবন । গ্রামীণ কিশোরী বধূ কিংবা শহুরে আধুনিক মেয়ের চরিত্রে বেশ সাবলীলভাবে অভিনয় করেছেন ববিতা। তাঁর সময় তরুণীদের কাছে ফ্যাশনের অপর নাম ছিল ববিতা। জহির রায়হান পরিচালিত “টাকা আনা পাই” চলচ্চিত্র তাঁর অভিনয় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।ববিতার জীবনের প্রথম সুপারহিট চলচ্চিত্র নজরুল ইসলাম পরিচালিত “স্বরলিপি”। ভারতের সত্যজিৎ রায় পরিচালিত “অশানি সংকেত” ববিতার অভিনয় জীবনের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে তিনি “অনঙ্গ বউ” চরিত্রে অভিনয় ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন। ববিতা ও জাফর ইকবাল জুটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্নযুগের জনপ্রিয় ও রোমান্টিক জুটি। একসাথে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে বেশ ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। গুজব আছে তাদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা ছিল। তবে পর্দায় প্রেম করে তারা সফল হলেও বাস্তবে তা হতে পারেননি।

তাছাড়া ববিতা জাফর ইকবাল ছাড়া অন্য নায়কদের সাথে অভিনয় করেও সফল হয়েছেন। ফারুক, উজ্জ্বল, রাজ্জাক, সোহেল রানা, ওয়াসিম, বুলবুল আহমেদ ছিলেন ববিতার রোমান্টিক নায়ক। বাংলাদেশের আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নায়িকা হিসেবে তিনি স্বীকৃত। সত্যজিৎ রায়ের অশনী সংকেত ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয় করে ববিতা ঈর্ষনীয় সাফল্য পান।দেশে বিদেশে অর্ধশতাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন চিরসবুজ এই অভিনেত্রী। ববিতার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – সংসার ,শেষ পর্যন্ত,অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ,আলোর মিছিল,গোলাপী এখন ট্রেনে,টাকা আনা পাই ,নয়ন মণি, অনন্ত প্রেম, এক মুঠো ভাত, জন্ম থেকে জলছি, চন্ডীদাস ও রজকিনী, অশনি সংকেত, রামের সুমতি, নিশান, নাগ-নাগিনী, লাভ ইন সিঙ্গাপুর, লাইলি মজনু, প্রতিহিংসা, নাগ পূর্ণিমা, স্বরলিপি,শ্বশুরবাড়ি,মিস লংকা,জীবন পরীক্ষা, জীবন সংসার ইত্যাদি । বর্তমান সময়ে ববিতা চলচ্চিত্রে নায়ক বা নায়িকার মা বা ভাবির চরিত্রে অভিনয় করছেন।

সুচরিতাঃ টিনএজ ইমেজ নিয়ে রুপালী পর্দায় হাজির হয়েছিলেন একটি মিষ্টি মেয়ে যার নাম সুচরিতা । সুচরিতা একজন শিশু শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ  Suchorita-Film-1-1করেন যখন তাঁর নাম ছিল বেবী হেলেন।

১৯৬৯ সালে শিশু শিল্পী হিসেবে বাবুল ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ‘বাবলু’ চলচ্চিত্রে তিনি শিশু শিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। নায়িকা হিসেবে সুচরিতা নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৭২ সালে পরিচালক আজিজুর রহমানের মাধ্যমে।

প্রথমদিকে তিনি খুব একটা সফল না হলেও পরে ভালোই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং প্রথম শ্রেণীর নায়িকা হিসেবে জায়গা করে নেন। ১৯৭৭ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘যাদুর বাঁশী’ ছবিটি তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয় রোমান্টিক চলচ্চিত্রে তাঁর সাথে জুটি গড়ে ওঠে ইলিয়াস কাঞ্চন, ওয়াসিম এবং উজ্জ্বলের সাথে।

সুচরিতার চমৎকার শারীরিক অবয়ব এবং ফটোজেনিক চেহারা তাঁকে একটা শক্ত ভীত গড়ে দেয়। তিনি একজন সু-অভিনেত্রীও ছিলেন। ক্যারিয়ারের এক জনপ্রিয় মূহুর্তে তিনি বিয়ে করেন চিত্র নায়ক জসিমকে তবে এই সংসার বেশী দিন টেকেনি এবং তিনি আবার চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন।

এ সময় তিনি বেশ কিছু বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে।

সুচরিতার উল্লেখ যোগ্য ছবিগুলো হলো – দোস্ত দুশমন , আপনজন, সমাধি, জীবন নৌকা, জনি, রঙ্গীন জরিনা সুন্দরী,ডাকু মনসুর ,কথা দিলাম, নাগর দোলা, দি ফাদার, বাল্য শিক্ষা , বদলা,গাদ্দার,দুনিয়াদারী,মোহাম্মদ আলী ,রকি,যাদুর বাঁশী ,মাস্তান, তাল বেতাল, সমাপ্তি, জানোয়ার ,আলোর পথে, ছক্কা পাঞ্জা, সোনার হরিণ,সোনার তরী, আসামী, তুফান, নদের চাঁদ, ঘর-সংসার, কুদরত, সাক্ষী ,আঁখি মিলন , ত্রাস, দাঙ্গা, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, এখোনো অনেক রাত সহআরও অনেক।

নূতনঃ নূতনের চলচ্চিত্র জগতে আগমন ঘটে ১৯৭০ সালে মুস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘নতুন প্রভাত’ সিনেমার মাধ্যমে।তারপর অল্প কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে 71তিনি চলচ্চিত্রে জগত থেকে সাময়িক বিদায় নেন। ১৯৭৮ সালে অভিনেতা রুহুল আমিন বাবুলকে বিয়ে করে আবার চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসেন।নূতন তাঁর ২৮ বছরের তারকা জীবনে প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছেন।অধিকাংশ ছবিতে তিনি ছিলেন সহ নায়িকা।বিনোদন মূলক চলচ্চিত্রের একজন নির্ভরযোগ্য তারকা ছিলেন নূতন।তিনি একজন দক্ষ অভিনেত্রীও ছিলেন।যে সমস্ত গুণাবলী একজন নায়িকার দরকার হয় তার সবই ছিল নূতনের।নৃত্যে তিনি অদ্বিতীয়া, চমকার ফিগার এবং সুন্দর মুখাবয়ব সবই ছিল তাঁর ।

৭০-এর দশকের নূতন কিছুটা ম্লান ছিলেন।৮০-এর দশকের তিনি যৌথ প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করতে থাকেন।৯০-এর দশকের প্রথমার্ধে নির্মাতারা তাঁকে একক নায়িকা হিসেবে আনার উদ্যোগ নেন।এক্ষেত্রে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘নাচে নাগিন’ ভালো ব্যবসা করে ও সুপারহিট হয়।তা সত্বেও শীর্ষ নায়িকাদের তালিকাতে তাঁর স্থান হয়নি।তাঁকে পর্দায় মাঝে মাঝে যৌনাবেদনাময়ী রূপ ফোটাতে গিয়ে ভ্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে।তিনি ১৯৮৭ সালে এবং ১৯৯১ সালে বাচসাস এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন । সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্ত্রীর পাওনা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য নূতন প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। নতুনের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – ওরা ১১ জন, পাগলা রাজা, রাজদুলারী, সৎভাই,কাবিন অত্যাচার,বারুদ,নাগিন,রাজনর্তকী,সতী নাগকন্যা,পাতাল বিজয়, বিজয় , রাজলক্ষ্ণী শ্রীকান্ত ,নাগ নাগিনী,প্রহরী,নাচ নাগিনা নাচ,ব্যবধান,নতুন প্রভাতসংগ্রাম,বাদশা,ফান্দে পড়িয়া বগা,প্রাণ সজনী,বদনাম,অলংকার, সৎভাই,কাবিন , বনের রাজা টারজান (১৯৯৫), বাঘা বাঘিনী , নাচে নাগিন, নাগিনী সাপিনী, রূপসী নাগিন ,স্ত্রীর পাওনা প্রভৃতি ।

রোজিনাঃ রোজিনা চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৭৬ সালে ‘জানোয়ার’ ছবির মাধ্যমে। এর আগে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রনকারী পণ্য ‘মায়া বড়ি’র বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে সবার 81নজরে আসেন ।

পরে তিনি এফ, কবীর পরিচালিত ‘রাজমহল’ সিনেমার মাধ্যমে একক নায়িকা হিসেবে কাজের সুযোগ পান।এই ছবিটি সফল হয় এবং তিনি হাতে বেশ কিছু ছবি পান।রোজিনার বেশির ভাগ ছবিই পোষাকী।

সুঅভিনয় ও গ্ল্যামার দিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।১৯৮০ সালে রোজিনা ‘কসাই’ ছবির জন্য জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর হিসেবে ‘জীবন ধারা’ ছবির জন্য।শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি বাচসাস পুরষ্কারও লাভ করেন ।

রোজিনার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্য জানোয়ার, রাজমহল, মাটির মানুষ,অভিযান, শীষনাগ , চম্পা চামেলী,মোকাবেলা,সংঘর্ষ,আনারকলি, রাজনন্দিনী, রাজকন্যা, শাহী দরবার, আলীবাবা , সিন্দবাদ, সুলতানা ডাকু, যুবরাজ, রাজসিংসন, শাহীচোর, দ্বীপকন্যা, জিপ্সী সরদার, কসাই, জীবনধারা , দোলনা, দুনিয়া উল্লেখযোগ্য । তবে তিনি বাংলাদেশের সিনেমা জগত থেকে নির্বাসনে আছেন এবং বর্তমানে তিনি দেশের বাইরেই বাস করেন।

অঞ্জু ঘোষঃ ৮০র দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের ফোক ফ্যান্টাসি ছবির জনপ্রিয় নায়িকা অঞ্জু ঘোষের আগমন ঘটে। চলচ্চিত্রে আগমনের আগে তিনি চট্টগ্রামের মঞ্চে anju-ghosh-664x1024বাণিজ্যিক নাটকের অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।তাঁর আসল নাম অঞ্জলী ঘোষ। ১৯৮২ সালে এফ, কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে।

এই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। দর্শক অবাক বিস্ময়ে তাঁর অশালীন অঙ্গভঙ্গি এবং উম্মাতাল নৃত্য উপভোগ করেন।তিনি বাংলার নীলো নামে পরিচিত ছিলেন।তিনি রাতারাতি তারকা বনে যান।অনেকের মতে অঞ্জুর সাফল্য ছিল ভিত্তিহীন মৌলিক সাফল্য।

অঞ্জু বাণিজ্যিক ছবির তারকা হিসেবে যতটা সফল ছিলেন সামাজিক ছবিতে ততটাই ব্যর্থ হন।১৯৮৬ সালে তাঁর ক্যারিয়ার বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও তিনি ফিরে আসেন ভালোভাবে।১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি সিনেমাতে অভিনয় করেন মন্দার সময়ে যেগুলো ছিল সফল ছবি।তাঁর অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড।

তিনি সুঅভিনেত্রীও ছিলেন।১৯৯১ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুনের আগমনে শাবনাজদের মতো নায়িকাদের দাপটে তিনি ব্যর্থ হতে থাকেন।তিনি এই দেশ ছেড়ে চলে যান এবং কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন।বর্তমানে তিনি ভারতে বিশ্বভারতী অপেরায় যাত্রাপালায় অভিনয় করছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে অঞ্জু ঘোষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া র ভোলানাথ অপেরার হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন করতেন ও গানও গাইতেন।

অঞ্জু ঘোষের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – সওদাগর , নরম গরম , বড় ভালো লোক ছিল, আবে হায়াত, রাই বিনোদিনী, পদ্মাবতী, আশীর্বাদ , প্রান সজনী, আয়না বিবির পালা , বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, প্রেম যমুনা ।

চম্পাঃ চিত্রনায়িকা সুচন্দা ও ববিতার বোন চম্পা । তিনি প্রথমে মডেলিং-এর মাধ্যমে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন।তারপর টিভি নাটকে অভিনয় করতে থাকেন এবং 10জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘তিনকন্যা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চম্পা চলচ্চিত্রের জগতে আগমন করেন।চম্পার অভিনয় দক্ষতা ও ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে চলচ্চিত্রে সাফল্য এনে দেয়।সামাজিক ও অ্যাকশন উভয় প্রকার সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছেন।কোন নির্দিষ্ট গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি।তিনি সত্যজিত রায়ের ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের ‘টার্গেট’ সিনেমাতে এবং বুদ্ধদেব দাশ গুপ্তের ‘লালদরজা’ সিনেমাতে অভিনয় করার সুযোগ পান।এভাবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। চম্পার মূল বৈশিষ্ট্য গ্ল্যামার, ফ্যাশন সচেতনতা এবং পোষাকে বৈচিত্র্য।গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ চলচ্চিত্র ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় মাপের কাজ।১২ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ১০০-এর বেশি সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন।বর্তমানে তিনি পর্দায় অনুপস্থিত। ৮০র দশকের শেষ দিক থেকে ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চম্পা দুর্দান্তভাবে একের পর এক ছবি উপহার দিয়ে গেছেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – তিনকন্যা, নিস্পাপ, নীতিবান, ভেজা চোখ, শঙ্খনীল কারাগার, গর্জন, সহযাত্রী, লটারি, বাপ বেটা ৪২০, অচেনা, বাসনা, পদ্মা নদীর মাঝি , কাসেম মালার প্রেম, শাদী মোবারক, ত্যাগ , গরম হাওয়া, সাক্ষাৎ, মা মাটি দেশ, মাটির কসম, অন্ধ প্রেম , প্রেম দিওয়ানা, ডিস্কো ড্যান্সার, ঘৃণা, শেষ খেলা , বিশাল আক্রমণ সহ প্রভৃতি ।

দিতিঃ ১৯৮৪ সালের এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম থেকে বের হয়ে আসেন নায়িকা পারভীন সুলতানা দিতি। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র উদয়ন 112চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি।

দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘আমিই ওস্তাদ’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আজমল হুদা মিঠু। এরপর দিতি প্রায় দুই শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রী’ ছবিতে দিতি আলমগীরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবিতেই অভিনয় করে দিতি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। দিতি অ্যাকশন লেডি হিসেবেও বেশ সুনাম অর্জন করেন।নব্বইয়ের দশকের পুরোটা জুড়েই দিতিকে দেখা গেছে ভিলেনদের সাথে যুদ্ধ করতে।

আজকের হাঙ্গামা, খুনের বদলা, লেডি ইন্সপেক্টর, পাপী শত্রু, প্রিয় শত্রু ,এরকম বহু ছবিতে অ্যাকশন লেডির চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।

দিতির উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – আমিই ওস্তাদ, হিরামতি , ভাই বন্ধু , উছিলা, প্রেমের প্রতিদান , মাস্তান রাজা, আজকের হাঙ্গামা, চাকর, সৎ মানুষ, কালিয়া, বেপরোয়া, খুনের বদলা, লেডি ইন্সপেক্টর, পাপী শত্রু, প্রিয় শত্রু , গাড়িয়াল ভাই, বাঁশিওয়ালা, এই নিয়ে সংসার , চরম আঘাত, শেষ উপহার সহ খুনের বদলা, সহ প্রভৃতি।

শাবনাজঃ ৯০-এর দশকের শুরুতে মূলত গৎবাঁধা ছবি ও একই নায়ক-নায়িকা দেখতে দেখতে বাংলাদেশের জন সাধারণ মারাত্নক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।এমন 121সময়ে ‘চাঁদনী’ নামক চলচ্চিত্রের মুক্তি ছিল তাদের জন্য স্বস্তির।

প্রবীণ পরিচালকএহতেশাম অনেক ঝুঁকি নিয়ে ছবিটি তৈরি করেন এবং সফল হন।এই ছবিটি সুপারহিট হয়, যা পালটে দেয় তখনকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গতিধারা।

এরপর নাইম শাবনাজ জুটি একের পর এক ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিয়ে নতুনদের আগমনের যৌক্তিকতা প্রমান করেন । নায়িকা শাবনাজের পথ ধরে চলচ্চিত্রে শুরু হয় নতুন শিল্পীদের আগমন ধারা।

একে একে চলচ্চিত্রে আসেন শাহনাজ, শাবনূরের মতো নায়িকারা।ক্যারিয়ারের মধ্য গগনে তিনি তার প্রথম ছবির নায়ক নাঈমকে বিয়ে করে ফেলেন।

সংসারে মনোনিবেশ করায় তিনি আর চলচ্চিত্রে তেমন সময় দিতে পারেননি। আস্তে আস্তে শাবনাজ চলচ্চিত্র জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যান।তাঁর স্বামী নাঈমও চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নেন ।

শানবাজের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – চাঁদনী, লাভ, দিল , সোনিয়া, চোখে চোখে , অনুতপ্ত, আজকের হাঙ্গামা, টাকার অহংকার, অঞ্জলি, সাক্ষাৎ, আগুন জ্বলে, আঞ্জুমান , আশা ভালোবাসা, রাগ অনুরাগ , প্রেমের সমাধি ।

মৌসুমিঃ ৯০ দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপন ছিল ‘সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ী’র বিজ্ঞাপন । সেই বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন 25757_e1মৌসুমি। মিডিয়ায় সেটাই ছিল মৌসুমির প্রথম কাজ ।

এরপর ১৯৯৩ সালে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত ‘ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন করেন ।

প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত বাম্পার হিট হয়ে দর্শকদের পছন্দের তালিকায় চলে আসেন প্রথম ছবিতেই । এরপর বলতে গেলে সিনিয়র চম্পা, দিতির সাথে সমান তালে আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন পুরো ৯০ দশক ।

মৌসুমির অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – কেয়ামত থেকে কেয়ামত, অন্তরে অন্তরে, দেনমোহর, দোলা, লজ্জা, আত্মঅহংকার, প্রথম প্রেম , স্নেহ, ক্ষুধা, মুক্তির সংগ্রাম, ভাংচুর, স্বজন, আদরের সন্তান, বিশ্বপ্রেমিক, গরীবের রানী, পাপের শাস্তি, হারানো প্রেম, প্রিয় তুমি , সুখের স্বর্গ , গৃহবধূ, লুটতরাজ সহ প্রভৃতি।

 

শাবনুরঃ শাবনূর চলচ্চিত্রে আসেন প্রয়াত পরিচালক এহতেশাম এর হাত ধরে ‘চাঁদনী রাতে’ ছবির মাধ্যমে । প্রথম ছবিতে নায়ক ছিলেন সাব্বির যা ছিল তারও 14প্রথম ছবি । ‘চাঁদনী রাতে’ ছবিটি ব্যবসা সফল না হলেও প্রয়াত নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে জুটি গড়ে ওঠায় শাবনুর দর্শকদের গ্রহনযোগ্যতা পান । সালমান শাহের সাথে ‘তুমি আমার’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন । ছবিটি সুপার ডুপার হিট হলে সালমান শাবনুর জুটি গড়ে উঠে যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে । শাবনুরের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – চাঁদনী রাতে, তুমি আমার, হৃদয় আমার, বিক্ষোভ, চাওয়া থেকে পাওয়া, তোমাকে চাই, বিচার হবে, স্বপ্নের ঠিকানা, চিরঋণী, প্রেমের অহংকার, মহামিলন , জীবন সংসার, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, কে অপরাধী, মধুর মিলন , অধিকার চাই , আনন্দ অশ্রু , ভালোবাসি তোমাকে, প্রেমের তাজমহল , মন মানে না , হৃদয়ের বন্ধন , এ বাধন যাবে না ছিঁড়ে, সমাজকে বদলে দাও সহ প্রভৃতি

এই হলো আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের প্রধান নায়িকাদের সংক্ষিপ্ত গল্প । এছাড়াও কাজরি ( নয়নের আলো), কবিতা ( বীরপুরুষ), জিনাত ( ন্যায় অন্যায়), অরুনা বিশ্বাস ( ত্যাগ), শাহনাজ ( মহৎ) সহ আরও অনেকে সেই সোনালি দিনে আলো ছড়িয়েছিলেন যা আজ সবই স্মৃতি। আজ এই জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন একজন কবরী, শাবানা বা ববিতার বড় বেশি প্রয়োজন যারা আমাদের বাণিজ্যিক ছবির হারানো দিন আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন । চলচ্চিত্রের এই মন্দা অবস্থা কাটাতে সাহায্য করতে পারেন ।



মন্তব্য চালু নেই