‘জঙ্গিদের কাছে এমন তথ্য ছিল, যা পুলিশকে বেকায়দায় ফেলত?’
প্রচলিত ক্রসফায়ারের পাশাপাশি জঙ্গিদের গুলি করে হত্যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে৷ ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা ও মাদারীপুরের শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন শরিফুল ও ফাহিমের ক্রসফায়ার তুলেছে নানা প্রশ্ন৷
রোববার ভোররাতে ঢাকার মেরাদিয়া এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় শরিফুল ওরফে হাদি৷ পুলিশের দাবি, একটি মোটরসাইকেলে তিনজন যাওয়ার সময় পুলিশ চ্যালেঞ্জ করলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে৷ এরপর পুলিশ প্রতিরোধ করলে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় শরিফ৷ জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরায়৷ সেখানে অবশ্য সে মুকুল নামে পরিচিত ছিল৷
শরিফুল ছিল লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি৷ তবে পুলিশের ধারণা, সে একই ধরনের আরো সাতটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷ তাই তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়৷ পুলিশ জানায়, অভিজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে শরিফ হত্যার আগে অনুসরণ করছিল৷ এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজও নাকি রয়েছে পুলিশের কাছে৷
অভিজিতের বাবা অধ্যাপক ড. অজয় রায় বলেন, “আমি জানি না ঠিক কোন পরিস্থিতিতে অভিজিৎ হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন শরিফুল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে৷ তবে আমার কথা, আমি বিচার চাই৷ আদালতের মাধ্যমে বিচার চাই৷ শতভাগ নিশ্চিত না হলে কারুর বিচার করা যায় না৷ কোনো নির্দোষ লোকের ওপর যেন হত্যার দায় চাপানো না হয়৷”
অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে ড. রায় বলেন, “তদন্তের ব্যাপারে পুলিশ এখন আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না৷ এমনকি তারা কাউকে চিহ্নিত করতে পারলো কি পারলো না – তাও আমাকে জানায় না৷ সন্দেহভাজন শরিফুলের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাও আমি সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছি৷”
তিনি বলেন, “আমি পুলিশের সঙ্গে নিজেও আর কোনোরকম যোগাযোগ করি না৷ কারণ পুলিশ একই ভাঙা রেকর্ড বারবার শোনায়৷”
১৫ জুন মাদারীপুর সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলার ঘটনায় গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নামে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরিরের এক সদস্যকে জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়৷ আটকের পর ফাহিমকে নেওয়া হয় পুলিশ রিমান্ডে৷ কিন্তু রিমান্ডে নেওয়ার পর রিমান্ডে থাকা অবস্থায়ই শনিবার ভোররাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সে৷
জঙ্গি বিষয়ক গবেষক এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, “বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরিফুল এবং ফাহিম জঙ্গিদের ব্যাপারে ব্যাপক তথ্যের উৎস হতে পারতো৷ পুলিশের কথা অনুযায়ী, শরিফ লেখক-ব্লগারদের সব হত্যাকাণ্ডে জড়িত৷ তাই যদি হয়, তবে স্বাভাবিক বিবেচনায় তাকে বাঁচিয়ে রাখাই তো ছিল পুলিশের প্রথম কাজ৷ কিন্তু পুলিশ কেন তা করল না? তাকে বাঁচিয়ে রাখতে কেন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করল না তারা? এটাই আমার কাছে বড় প্রশ্ন৷”
“ফাহিম জঙ্গিদের ব্যাপারে ব্যাপক তথ্যের উৎস হতে পারতো”
নূর খান প্রশ্ন করেন, “এই জঙ্গিদের কাছে কী এমন তথ্য ছিল, যা বিবব্রতকর অবস্থায় ফেলতে পারতো পুলিশকে? আমরা জানি, জঙ্গিদের সঙ্গে সমাজে এবং প্রশাসনের প্রতিষ্ঠিত অনেকের যোগাযোগেরই অভিযোগ আছে৷ তাহলে কিছু একটা আড়াল করতেই কি তাদের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছিল?”
তিনি বলেন, “জঙ্গি কেন, কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই গ্রহণযোগ্য নয়৷ কারণ এরা যদি অপরাধী হয়ে থাকে, তাহলেও তো তাদের বিচারের মুখোমুখি করা গেল না৷ এর সেটা হলো না শুধুমাত্র বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার কারণে৷ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এটা কিন্তু জরুরি ছিল৷”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে৷ ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৩৫৪ জন নিহত হন৷ এরপর নিহতের সংখ্যা কমে আসলেও, ২০১৪ সাল থেকে আবারো বাড়তে থাকে এই সংখ্যা৷ ঐ বছর ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৮ জন৷ ২০১৫ সালে ১৪৬ এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৫৯ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন৷ আর এ পর্যন্ত গত প্রায় সাড়ে ১২ বছরে মোট নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৭১৫ জন৷
নূর খানের কথায়, “প্রতিটি ক্রসফায়ারের গল্প প্রায় একইরকম৷ এই গল্প আর বিশ্বাস করা যায় না৷”
সূত্র: ডয়চে ভেলে।
মন্তব্য চালু নেই