জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে
ছাত্রলীগের এক ‘সিন্ডিকেট’ ঠেকাতে সাত উপদল!
ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে কথিত ‘সিন্ডিকেট’ ঠেকাতে সক্রিয় হয়েছে আরও সাতটি পক্ষ বা উপদল। আর এসব উপদলের নেপথ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা অংশসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতা।
২৫ ও ২৬ জুলাই ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে এসব পক্ষ পছন্দের ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আনতে যাঁর যাঁর মতো চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করছে সংগঠনের সাবেক একজন সভাপতির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটই সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা রেখে আসছে অনেক দিন ধরে। তবে এ সিন্ডিকেটটি ভাঙতে এবার সাতটি নতুন উপদল সক্রিয় হয়েছে।
এ রকম একটি উপদলের পৃষ্ঠপোষকতায় আছেন আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছাত্রলীগ সবার। এখানে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে দেওয়া হবে না। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি।’ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা তাঁদের সঙ্গে আছেন বলে দাবি করেন এই নেতা।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির সঙ্গে সংগঠনের প্রায় সব নেতা-কর্মীই কমবেশি পরিচিত। আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের একটা অংশ তাঁদের ‘অনুসারীদের’ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আনতে এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলছেন।
অবশ্য ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান কাছে দাবি করেন, ‘ছাত্রলীগকে কোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে না।’ যদিও তিনি নিজে কথিত ওই সিন্ডিকেটের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক লিয়াকত শিকদার। এ ক্ষেত্রে তিনি আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার ‘আশীর্বাদপুষ্ট’। ছাত্রলীগের বিগত চারটি কমিটির নেতা নির্বাচনে এই সিন্ডিকেটই মূল ভূমিকা রেখেছে। ফলে জেলা কমিটিগুলোর বেশির ভাগই এদের অনুগত। যার কারণে এই সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে শুধু কেন্দ্রে নয়, তৃণমূলেও নেতা হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে বলে সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে ধারণা তৈরি হয়েছে। যার ফলে গত মে মাসে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নতুন কমিটি ঘোষণার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পদবঞ্চিতদের একটা অংশ সেগুনবাগিচায় লিয়াকত শিকদারের বাসায় হামলা চালায় বলে মনে করা হয়।
অবশ্য লিয়াকত শিকদার কাছে দাবি করেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি সংগঠনের একজন সাবেক কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগকে ভালোবাসি। এ হিসেবে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে একটি মহল নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক কথা ছড়াচ্ছে।’ ছাত্রলীগের এবারের সম্মেলনে তাঁর কোনো প্রার্থী থাকবে না বলেও তিনি দাবি করেন।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙার কথা বলে সক্রিয় পক্ষগুলো মূলত গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট এলাকায় বাড়ি এমন ছাত্রলীগ নেতাদের কেন্দ্র করে, যাঁরা আসন্ন সম্মেলনে পদপ্রত্যাশী। এর মধ্যে খুলনাকেন্দ্রিক অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় আছেন আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বরিশাল ও রংপুরকেন্দ্রিক অংশের পেছনে আছেন দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক। একইভাবে অন্যান্য বিভাগকেন্দ্রিক পদপ্রত্যাশীদের পেছনে আছেন আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীতে আছেন এমন তিনজন নেতা ও ছাত্রলীগের একজন সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, ছাত্রলীগ সারা দেশে আওয়ামী লীগের স্ট্রাইকিং ফোর্স। ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা যাঁদের অনুগত, মূল দলে তাঁদের প্রভাবই থাকে বেশি। এ জন্যই আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের প্রভাব রাখতেই পছন্দের প্রার্থীর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।’
অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘নতুন নেতা কে হচ্ছেন, সেটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই।’
এদিকে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে যে পরের কমিটিতে কাঁরা আসবেন, সেটা একপ্রকার ঠিকই করে ফেলেছে কথিত ওই সিন্ডিকেট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান বলেন, ‘প্রার্থী সিলেক্ট করার কোনো বিষয় আমাদের জানা নেই। এটা চাইলে নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী) করতে পারেন।’
আগামী ২৫-২৬ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলন হবে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। তবে তা ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে হবে, না কি অন্য কোনো পদ্ধতিতে, সেটা এখনো স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এ বিষয়ে এইচ এম বদিউজ্জামান বলেন, ‘সমঝোতার ভিত্তিতে যদি কমিটি করা যায়, সেটাই করা হবে। তা না হলে অন্যান্য যেসব পূর্বশর্ত (ক্রাইটেরিয়া) আছে, সেগুলোর মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হবে।’
নতুন কমিটিতে পদপ্রত্যাশী এমন ১৫ জন ছাত্রলীগ নেতার গত এক সপ্তাহের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, তাঁরা দিনের একটা বড় সময় নিজ নিজ বলয়ের আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসা, কার্যালয় কিংবা যেখানে গেলে তাঁদের পাওয়া যাবে সেসব জায়গায় থাকেন।
ছাত্রলীগের পদ পেতে ২৯ বছর বয়স একটি অন্যতম পূর্বশর্ত। এ ছাড়া বলা হয়েছে, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিশ্বাস ও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে নিতে পারবেন, তাঁরাই হবেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের অধিকারী। কিন্তু ছাত্রলীগের একজন সহসভাপতি বলেন, ‘ওগুলো কাগজে কলমের পূর্বশর্ত। মূল কথা হলো—আঞ্চলিকতা, লবিং-গ্রুপিং।’ প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই