ছাত্রদলে বিদ্রোহের নেপথ্যে

বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের নেপথ্যের মদদদাতাদের নিয়ে চলছে জোর আলোচনা সমালোচনা। এই বিদ্রোহে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, যুগ্ম মহাসচিবরাও ইন্ধন দিচ্ছেন বলে এমন অভিযোগ খোদ দলের নেতাকর্মীদেরই।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের(বিএনপি) সরকার পতনের আন্দলন-সংগ্রামকে আরও চাঙ্গা করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজ উদ্যোগে ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করেন। নতুন কমিটি গঠন করার প্রসঙ্গে শিক্ষক, রাজনীতিক, ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন তিনি।

কিন্তু এত কিছুর পরও কমিটি ঘোষণার পরপরই শুরু হয় পদবঞ্চিত নেতাদের বিদ্রোহ। নব্য কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল রাজধানী কেন্দ্রীক নয় বরং সিলেট, রাজশাহী, বরিশালের মত জেলাতেও ছড়িয়ে পরেছে। কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে চেয়ারপারসন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে তলব করতে বাধ্য হয়েছেন।

এদিকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার বিকালে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন সাবেক ছাত্রদল নেতার সঙ্গে মিটিং করেন এবং বিদ্রেহীদের উত্থাপিত দাবি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জানানো হবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে সে দিনের মত বিদ্রোহ কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়।

এখন আলোচনার মাধ্যমে বিএনপি ছাত্রদলের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম না হলে ভবিষ্যতে ছাত্রদলই বিএনপি রাজনীতির জন্য ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’র কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যার প্রভাব পরবে বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও।

ছাত্রদলে

কেন এই বিদ্রোহ?
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কাঙ্খিত পদ না পেয়ে কিছু সংখ্যাক সাবেক ছাত্র নেতা নতুন কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। কিন্তু বিদ্রোহের আসল কারণ খুঁজতে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিদ্রোহের পিছনে যতটা না পদ পাওয়া বিষয়টি জড়িত তারচেয়ে বেশি জড়িত বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়।ফলে বিদ্রোহটা এবার বেশ ভালভাবেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মূল দাবি এ্যানী-টুকুকে তাদের স্বপদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং একই সঙ্গে বর্তমান কমিটির সভাপতি রাজীব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানকে সরিয়ে নতুন করে কমিটি গঠন করতে হবে। রোববার বিকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠকের সময় বিদ্রোহীরা এ দাবিই তুলে ধরেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন গঠিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পিছনে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও জড়িত রয়েছে। ভবিষ্যত রাজনীতিক ফায়দা লোটার কথা চিন্তা করে দায়িত্ব প্রাপ্ত বিএনপির কিছু কেন্দ্রীয় নেতা যেমন ছাত্রদলের কমিটি বাগিয়ে নিয়েছেন তেমনি আরও একদল নেতা নিজদের পদ-পদবী ও প্রভাব হারানোর ভয়ে বিদ্রোহীদের ইন্ধন দিয়ে কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া পায়তারা করছেন।

হাবিব উন নবী খান সোহেল বনাম নাছির উদ্দিন পিন্টু

অভিযোগ আছে, বিএনপির ছাত্র বিষয় সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ও সেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলের সঙ্গে আতাঁত করে রাজীব ও আকরামকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটি গঠন করিয়ে নেয়।

কিন্তু এ কমিটি বিডিআর বিদ্রোহের বিচারে সাজা প্রাপ্ত বিএনপির মহানগরের নেতা নাছির উদ্দিন পিন্টুর ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ হাবিবুর নবী সোহেল যেভাবে মহানগরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে নীল নকশা আকছে এতে ভবিষ্যতে মহানগরে পিন্টুর রাজনীতি সুখকর নাও হতে পারে তাই তার পছন্দের লোক রাকিবুল ইসলাম রয়েল ও ইসহাক সরকাকে দিয়ে ছাত্রদলের কিমিটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তার অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

সুলতাল সালাউদ্দিন টুকু বনাম খাইরুল কবির খোকন

বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল কবির খোকন যুবদলের সভাপতি পদ প্রত্যাশী। এ দৌড়ে তিনি অনেকটা এগিয়েও আছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে সুলতালন সালাউদ্দিন টুকুও একই পদ পেতে করতে চান।

তাই খাইরুল কবির খোকনকে পিছনে ফেলার জন্য অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন আকরামুল হাসানকে। কারণ আকারামুল হাসান ও খাইরুল কবির খোকনের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। এ ক্ষেত্রে একই এলাকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির নেতা বানাতে চাইবে না বিএনপির হাইকমান্ড। ফলে এতে সুবিধা নিবে সুলতাল সালাউদ্দিন টুকু। এদিকে বিদ্রোহে খাইরুল করিব খোকনের নাম শোনা না গেলেও তার সমর্থন রয়েছে বলে জানা গেছে।

ছাত্রদলে বিদ্রোহে

এ্যানী-পার্থ বনাম নাজিম-নিরব

বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে শহীদ উদ্দিন এ্যানীর হুমকির কারণ। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার ব্যাপারে শহীদ উদ্দিন এ্যানী নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চান।

অন্যদিকে, এলাকায় নাজিম উদ্দিন আলম, আন্দালিব রহমান পার্থের রাজনৈতিক হুমকির কারণ। তাই আন্দালিব রহমান পার্থ ও শহীদ ‍উদ্দিন চৌধুরি এ্যানী এক হয়ে রাজীবকে সভাপতি বানানোর সুপারিশ করেছেন। কারণ নাজিম উদ্দিন আলম ও রাজীব আহসানের বাড়ি একই এলাকায়। সুতরাং এই ক্ষেত্রে একই এলাকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ নাও দেয়া হতে পারে। ফলে তারা থাকবে নিরাপদ অবস্থানে। আন্দালিব রহমান পার্থ এবার ওমরা পালন করতে গিয়ে ছাত্রদলে কমিটির ব্যপারে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন।

আবার যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নীরব আবারও সপেদে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই তাকে ঠেকাতে রাজীব আহসানকে ছাত্রদলের সভাপতি বানানো হয়েছে। রাজীব আহসান ও সাইফুল ইসলাম নীরবের বাড়িও ভোলায়।

এছাড়া পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভে ইন্ধনদাতা হিসেবে সাবেক ছাত্রনেতা আমানউল্লাহ আমান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসেরও মৌন সমর্থন রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে, গত কয়েক বছর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কার্যত অবরুদ্ধ। কার্যালয়ের নিচে পুলিশের অবস্থান স্থায়ী রূপ নিয়েছিল। সেখানে দশ-বারোজন দলীয় নেতাকর্মীকেও একত্র হতে দেয়নি পুলিশ।

কিন্তু গত তিন দিনের চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। কার্যালয়ের সামনে পুলিশ থাকলেও পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ করছেন, হামলা-ভাঙচুর চালাচ্ছেন। ককটেলের বিস্ফোরণও হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ নীরব।  বিএনপির নীতির্ধারক নেতারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বিক্ষোভ ও হামলার পেছনে সরকারের মদদ রয়েছে।

কমিটির বিদ্রোহ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরি এ্যানী বলেন, ‘ছাত্রদলের জটিল পরিস্থিতি সমাধানের পথে। এ কমিটি নিয়ে সরকার সুযোগ খুঁজছে এবং সেটা তারা নিয়েছেও। কিন্তু সরকার যেন আর সুযোগ নিতে না পারে তা নিয়ে সতর্ক আছি।’

বিদ্যমান পরিস্থিতি সমাধা বিষয়ে এ্যানী বলেন, ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মির্জা আব্বাস পদবঞ্চিতদের বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। তারা পার্টি অফিসে থাকবেন, সবার সঙ্গে কথা বলবেন। তারাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। এরপর যদি কেউ সংগঠন পরিপন্থি কাজ করে তাহলে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম সিদ্ধান্ত নেবে।’

পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতা রাকিবুল ইসলাম রয়েল বলেন, ‘মির্জা আব্বাসের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হবে। যদি আমাদের দাবি না মানা হয় তাহলে আবারো অবস্থান কর্মসূচি দেয়া হবে।’

কমিটি নিয়ে বিদ্রোহের বিষয়ে কী ভাবছেন, জানাতে চাইলে বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট  বলেন, ‘নতুন কোন কিছু সৃষ্টি হলে তার একটা প্রভাব বা রেশ থাকে। ছাত্রদল কমিটির ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এখন বিদ্রোহ হচ্ছে আর কিছু দিন পর এটা থাকবে না। এমন কি আগামী কালও বিদ্রোহ থেমে যেতে পারে।’

পদবঞ্চিতদের মধ্যে নেতৃত্বে যাদেরকে দেখা গেছে তারা হলেন- বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী রিদওয়ানুল হক রিয়াজ, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান সুমন, তারিকুল ইসলাম টিটু, রাকিবুল ইসলাম রয়েল, রফিকুল ইসলাম রফিক, সাবেক সহ-যোগাযোগ সম্পাদক দবির উদ্দিন তুষার, লালবাগ থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন বাবু।

এ ছাড়া শাকিল নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতাকেও বেশ সক্রিয় দেখা গেছে। তবে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার পদবঞ্চিতদের আন্দোলনে
নেপথ্যে আছেন বলে অভিযোগ উঠলেও তিনি নয়াপল্টনে আসেননি এবং সাবেক ছাত্রনেতা এসএম ওবায়দুল হক নাসির শুরুতে বিক্ষোভে অংশ নিলেও সংঘর্ষের সময় তাকে দেখা যায়নি।



মন্তব্য চালু নেই