চাকরি বা বিয়ে নয়, দেশ গড়ার প্রত্যয়ে মাঠে কৃতী ছেলেমেয়েরা

প্রথাগত ধারার বাইরে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশকে বদলে দেওয়ার সামাজিক সংস্কারে নেমেছেন ভারতের কিছু উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে। ওদের কেউ ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, অচিরাচরিত শক্তি, সমাজ বিজ্ঞান পাশ করেছেন। চাইলেই তারা মোটা বেতনের চাকরি পেতে পারতেন। কিন্তু লোভনীয় সেই সব চাকরি ছেড়ে ভারতের এই ছেলেমেয়েরা স্রোতের বিপরীতে হেঁটে নতুন সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। খবর এবেলার।

মেধাবী এই ছেলেমেয়েদের কেউ লাদাখে, কেউ বিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় বা মধ্য প্রদেশ, উড়িষ্যার গণ্ডগ্রামে মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজ করে চলেছেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষকে অনুপমা, তুষার, নিকিতা ও সুর্যরা তাদের এই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন ভোরের আলো দেখাতে চলেছেন।

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের চাষবাসে জলসঙ্কট, যক্ষ্মার আক্রমণ, ১০০ দিনের কাজের সুবিধা না পাওয়া, এলাকাবাসীর সুসংহত উন্নয়ন, অশিক্ষা দূরীকরণের পাশাপাশি অন্ধ সংস্কার থেকে মুক্তি, বিকল্প রোজগার, আদিবাসী উন্নয়নের মতো বহু সমস্যার সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এরা।

২০১০ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মেধাবী ছেলেমেয়েদের নিয়ে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়া ফেলো স্যোস্যাল লিডারশীপ ফোরাম’।এ ই ফোরামে বিভিন্ন রাজ্যের ছেলেমেয়েরা শুরুর সময় থেকেই কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন গ্রাম, শহর, উপজাতি, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কাজ করে চলেছেন।

সেখানকার মানুষের সমস্যা কী, সমাধানের রাস্তা কী, মানুষ কী চাইছেন, সরকারি পরিষেবাই বা কী পাচ্ছেন বা পাচ্ছেন না ইত্যাদি বিষয়গুলি মানুষের কাছে পৌছে, তাদের মুখ থেকে শুনে, ডকুমেন্টেশন করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এবং রাজ্য ও কেন্দ্রকে জানিয়ে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে বলে জানালেন ফোরামের

অন্যতম কর্মী ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা অনুপমা পাইন।

মুম্বাই নিবাসী নিকিতা ডিক্রুজ এই ফোরামের মধ্যে থেকে জানিয়েছেন, মধ্যপ্রদেশের একাধিক গ্রামে ১০০ দিনের প্রকল্পে গ্রামবাসীরা জব কার্ড পেয়েও কাজ পাচ্ছেন না। কাজ করেও মজুরি পাচ্ছেন না। অথচ তারা স্থানীয় সরপঞ্চ বা প্রধানকে অভিযোগ জানাতে ভয় পান। নিকিতা সরপঞ্চকে এবং প্রশাসনকে বলে কাজের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি করেও সমাজ শোধরানোর কাজেই চাকরি না করে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।

রাজস্থানের তুষার গর্গ দু’বছর হল এমবিবিএস পাশ করেছেন। কিন্তু ফোরামে এসে বিহারের সমস্তিপুর জেলার দারসিং সরাই গ্রামে পড়ে রয়েছেন যক্ষ্মা-সহ অন্য রোগ নিয়ে মানুষের পাশে থেকে কাজ করছেন। মানুষের রোগ নিরাময় নিয়ে অন্ধ ধারণা দূর করে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো, সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্যার কথা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সরকার কে জানিয়ে সমাধানের রাস্তা বের করেছেন।

কর্নাটকের অঙ্কে মাস্টার ডিগ্রি করা এবং অচিরাচরিত শক্তি নিয়ে পড়াশুনা করা সূর্যনারায়ণ বালসুব্রহ্মনিয়ন ফোরামের সাহায্যে বর্তমানে গত দু’বছর ধরে কাশ্মীরের লাদাখে জলকে কিভাবে বরফ করে রেখে শুখা মরশুমে সেই বরফ গলিয়ে জল দিয়ে চাষবাস করা যায়, সেই প্রকল্প সফল করে তুলেছেন। সূর্যর এই সাফল্যে তাকে নিউজিল্যান্ডে ডাকা হয়েছে প্রকল্পকে নতুন রূপ দেওয়ার জন্য।

কেরালার আদর্শ ভাট অর্থনীতি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন নিয়ে পড়াশুনার পাট চুকিয়েছেন। বর্তমানে তিনি উড়িষ্যায় বিভিন্ন আদিবাসী, জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে সরকারি রেশনিং ব্যবস্থায় এলাকাবাসী আদৌ কোনও সুবিধা পাচ্ছেন কি না, দেকছেন। প্রশাসন এবং সরকারকে জানিয়ে সঠিক পরিষেবা দেবার ব্যবস্থা করেছেন।

অনুপমা জানিয়েছেন, তারা ইচ্ছে করলেই মোটা মাইনের চাকরি যখন তখন পেতে পারেন। অনেক অফার পেয়েও তারা চাকুরিতে যোগ দেননি। ফোরাম গঠনের সেই ২০১০ সাল থেকেই প্রথম ব্যাচের সদস্যা হিসেবে কাজ করছেন। তবে তাদের মোট ৭৬জন কর্মীর মধ্যে অধিকাংশই বিয়ের যোগ্য হলেও বিয়ে করেন নি। সামাজিক কাজই তারা যতোদিন পারবেন করে যাবেন। সবার পারিবারিক সম্মতিও নিজেরা এই কাজের জন্য আদায় করেছেন। তবে ফোরামের সাথে যুক্ত থাকলেও নিজদের এলাকায় অন্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

এই ফোরামের সদস্য সদস্যাদের এই রাজ্যে ৫ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিল সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অফ হিউম্যান ইনিশিয়েটিভ। সংস্থার জলপাইগুড়ি শহরতলির রাজবাড়ি পাড়ার সদর কার্যালয়ে এই প্রশিক্ষণ রবিবার শেষ হয়েছে। সংস্থার অধিকর্তা রাজেশ্বর মিশ্র জানান, এই ছেলেমেয়েরা দেশের হয়ে নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এঁদের অবস্থা অনেকটা নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো। চাকরির এদের বাইরে সামাজিক দায়িত্ব পালন করাই বড় লক্ষ হয়ে দাড়িয়েছে।

এই সংস্থার কোঅর্ডিনেটের সুব্রত মজুমদার জানান, দু’দিন এই ১১ জনের ফোরামের দলটিকে আলিপুরদুয়ারের বক্সা পাহাড়ে নিয়ে যান। তারা সেখানকার দুর্গম রাস্তা,মানুষের স্কুল আছে, শিক্ষক নেই, পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবা কোন জায়গায়— সব কিছুই ঘুরে দেখেন। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বৈঠক করে সমস্যা জেনেছেন।

এই ফোরামকে এখন আর্থিক সাহায্য করছে টাটা ট্রাস্ট।এ ই আর্থিক সহযোগিতা শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার জন্য। মাসিক সামান্য সে স্টাইপেন্ড দেওয়া হয়, চাকরি করলে তার দশগুণ বেশি টাকা রোজগার করতে পারতেন। কিন্তু নিজেদের সুখ-শান্তি, বিলাসবহুল জীবনযাপনকে দূরে সরিয়ে রেখে এই ছেলেমেয়েদের এই দায়িয়্ববোধ বাস্তবিকই ‘সামাজিক আন্দোলনে’ রূপ নিতে চলেছে।



মন্তব্য চালু নেই