মমতার বাংলাদেশ সফর
বিরোধিতা থাকলেও যে কারণে মমতার সফলতায় মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো, এ কথা পাগলেও বলবে না। বস্তুত গত বছর লোকসভা নির্বাচনের সময় মোদি সম্পর্কে মমতা যেসব বাছাবাছা শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন তার, অনেকগুলোই ঠিক মুদ্রণযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জনাব মোদির সঙ্গে দেশের একমাত্র যে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও বৈঠকে মোলাকাত পর্যন্ত হয়নি, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এমন ঘোর শত্রুরও চলতি বাংলাদেশ সফরটা পুরোদস্তুর সফল হোক, এটাই চায়ছেন নরেন্দ্র মোদি সরকার।
এর কারণ আর কিছু নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি আর তিস্তার পানি ভাগাভাগির মতো দুটি দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত বিষয়ের নিষ্পত্তির রাস্তা খুলে যাক, এটাই চায় ভারত সরকার। আর যার আপত্তির কারণে বিষয় দুটির নিষ্পত্তি হয়নি বলে ধারণা, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ঢাকায় গিয়ে যদি সুর নরম করেন তাহলে তারচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? এতে মমতার রাজনৈতিক লাভ হবে কি না পরের প্রশ্ন, কিন্তু তাকে রাজি করানোর কৃতিত্ব নিয়ে নরেন্দ্র মোদির কূটনৈতিক লাভ যে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই!
সে কারণে এই সফরে সবুজ সংকেত দিতে এতটুকু দেরি করেনি নরেন্দ্র মোদি সরকার। সুত্র মতে একুশের ভাষা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেন আমন্ত্রণ জানানো হয়, তার জন্য ঢাকাকে ‘ফিলার’ (কৌশলি প্রস্তাব) পাঠিয়েছিল দিল্লি-ই!
আসলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে একজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের সরকারের সরাসরি কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠুক, এটা অভিপ্রেত নয়। দিল্লি কখনও তা চায় না। বস্তুত শেখ হাসিনার গত সরকারের আমলে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি অনেকটা নিজের গরজে কলকাতা গিয়ে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বরফ গলানোর চেষ্টা করছিলেন- তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। দিল্লি বা কলকাতা কেউ তাতে খুশি হয়নি। দীপু মনির জন্য সেটা ছিল একটা ডিপ্লোম্যাটিক ব্লান্ডার।
এবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরের পটভূমি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। রাজনৈতিক কারণে সম্প্রতি কয়েক মাস ধরে মমতা যখন ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন তিস্তা বা ছিটমহল বিনিময় নিয়ে তিনি নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে রাজি, দিল্লি বুঝতে পারে এটাই তাকে ঢাকা পাঠানোর সেরা সময়! সেই অনুযায়ী ‘ফিলার’ পাঠানো হয় শেখ হাসিনা সরকারকে- তারা সে প্রস্তাব লুফে নিয়ে মমতাকে আমন্ত্রণ জানান, আর এক কথায় রাজি হয়ে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
দিল্লি কিন্তু শুধু এই সফরের জন্য রাস্তা পরিস্কার করেই ক্ষান্ত দেয়নি, তিস্তা আর ছিটমহল বিনিময় প্রশ্নে যেন বলার মতো অগ্রগতি হয়, সে জন্য নীরবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে! সেটা কী রকম?
প্রথমত, ঢাকায় যিনি ভারতের হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন সেই পঙ্কজ শরণকে এই সফরের ঠিক আগে পাঠানো হয়েছিল কলকাতায়- যেন সেখানে গিয়ে তিনি নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের সঙ্গে দেখা করেন। কল্যাণ রুদ্র হলেন সেই নদী বিশেষজ্ঞ, যাকে মমতা সরকার তিস্তায় জলের প্রবাহ খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কমিশন করেছিলেন। কল্যাণবাবু যথাসময়ে তার প্রতিবেদনের কাজ শেষ করে মমতার সরকারের কাছে তা জমাও দিয়েছিলেন- কিন্তু সেই প্রতিবেদনে কী আছে তা নিয়ে মুখ খোলেননি।
পঙ্কজ শরণ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত এসেছিলেন দিল্লিতে বিভিন্ন দেশের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে যোগ দিতে। ঢাকায় ফেরার পথে তিনি কল্যাণবাবুর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করে যান- তার কাছে বুঝতে চান তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল সমস্যা কিছু আছে কি না, থাকলে তার সমাধানটাই বা কী। এর কারণ হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সফরে যখন তিস্তার কথা উঠবে, তখন ভারতীয় দূতাবাস যেন প্রয়োজনীয় ‘টেকনিক্যাল ইনপুট’ দিতে পারে- এবং সেটা মমতার পছন্দের বিশেষজ্ঞকে উদ্ধৃত করেই- সে জন্য এই হোমওয়ার্ক করে রেখেছিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।
দ্বিতীয়ত, মমতার এই ঢাকা সফরের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে সীমান্ত এলাকার ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের নিয়ে সমীক্ষার কাজ। এই জরিপের উদ্দেশ্য হলো, ছিটমহলবাসীরা কারা কোন দেশ যেতে চান, ভারত না বাংলাদেশ কোন দেশের নাগরিকত্ব চান- এবং যাদের জমি-বাড়ি হারাতে হবে, তাদের কতটা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য সেগুলো নির্ধারণ করা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, ছিটমহলবাসীরা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক প্যাকেজ পেলে এবং সেটা রাজ্য সরকারের মাধ্যমে খরচ করা হলে ছিটমহল বিনিময়ে তিনি অরাজি নন। মমতার ঢাকা সফরের আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সেই প্রতিক্রিয়াটা জোরেসোরে শুরু করে দেওয়ার এটাও একটা বড় কারণ- যেন তিনি বাংলাদেশ গিয়ে ছিটমহল নিয়ে কোনও অজুহাত না দিতে পারেন।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কথায়, ‘আমরা এমনভাবে এই সফরের জন্য গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে রেখেছি, যেন এটা সফল হয়- দু’ পক্ষের মুখে হাসি দেখা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে, তা তো অনেকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর নির্ভর করছে।’
নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিবেশী দেশে পাঠিয়ে কূটনৈতিক লাভ হাসিল করার চেষ্টা নরেন্দ্র মোদির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ (দারুণ মার) নিঃসন্দেহে, তবে তাতে কতটা কাজ হয়, সেটা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।
তথ্যসুত্র বাংলা ট্রিবিউন
মন্তব্য চালু নেই