ঘুষের বাজারদর

ঘুষকে ‘ঘুষ’ বললে ঘুষখোরদের সম্মানে ঘা লাগে। তাই ‘সালামি’, ‘সম্মানী’, ‘বকশিশ’, ‘সার্ভিস চার্জ’, ‘নজরানা’, ‘চা-পানির খরচ’, ‘স্পিড মানি’, ‘পারসেন্টেজ’, ‘গিভ অ্যান্ড টেক’, ‘কমিশন’ ইত্যাদি নানা ‘সম্মানজনক নাম বা শব্দে’ চলছে ঘুষের অবৈধ লেনদেন। শুধু তা-ই নয়। ইতিপূর্বে বাঁ-হাতে বা ড্রয়ার খুলে দিয়ে স্পর্শ না করে ঘুষ গ্রহণের রেওয়াজ ছিল। এখন সেই রাখঢাক বজায় রাখা বা গোপনীয়তার তোয়াক্কা না করে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে প্রকাশ্যেই চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য।

তবে অফিস-আদালতে সিসি ক্যামেরা বাড়ায় বাসা-বাড়ি ও বাইরেই ঘুষের লেনদেন বাড়ছে। এতেই শেষ নয়। কোন কাজের জন্য ঘুষের হার কত সেই বাজারদরও এখন জনে জনে জানা। তাই ঘুষ ছাড়া কাজ করার পরিবর্তে উল্টো ঘুষের প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে কম খরচে কাজ আদায়ের চেষ্টা-তদবিরেই বাধ্য হচ্ছেন অসহায় গ্রাহকরা। তবু ঘুষের তেমন অভিযোগই পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় ফাঁদ পেতে ঘুষখোরদের ধরার অভিযানও নেই।

গত ১৭ই নভেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদপ্তরে প্রকাশ্য ঘুষ লেনদেনের নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। এতেই ক্ষান্ত ছিলেন না কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘুষের সঙ্গে বিনা রশিদে টাকা নিয়ে গ্রাহকদের ভূমির ম্যাপ ও খতিয়ান বা পর্চার ছায়াকপি সরবরাহ করে সরকারি ফি’র পুরোটাই মেরে দিচ্ছেন। সরজমিন দেখা যায়, ওইদিন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থেকে আসেন আবদুস সামাদ। অন্য প্রায় অর্ধশত গ্রাহকের সঙ্গে তিনি ওই অধিদপ্তরের প্রথম ও প্রধান করিডোর সংলগ্ন ‘গ্রহণ ও প্রেরণ বা আদান-প্রদান শাখায়’ অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, একটি ম্যাপের ছায়াকপির জন্য এর আগে কয়েকবার এসেছি। পাইনি। আজ এসে বাধ্য হয়ে সামনে বসে থাকা ওই ব্যক্তিকে (আঙুল দিয়ে কাউন্টারে বসা মামুনুর রহমানকে দেখিয়ে) ৫২০ টাকার কাজের জন্য ৭০০ টাকা দিয়েছি। আজ বিকালের মধ্যে দেয়া হবে জানিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে বলেছেন। এজন্য কোন রশিদও দেয়া হয়নি। একই ভাবে নির্ধারিত ৫২০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে অধিকাংশ গ্রাহককেই টাকা গ্রহণের রশিদ দেয়া হয়নি। অথচ ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদে টাকা আদায়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর পরপর তার সামনেই নিজেকে গ্রাহক পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদক কথা বলেন মামুনুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আগামী রোববার সরকারি ফি অনুযায়ী ৫২০ টাকা করে যত কপি প্রয়োজন ম্যাপ ও খতিয়ান বা পর্চার কপি দেয়া যাবে। রশিদ দেয়া হবে না। যেহেতু টাকা গ্রহণের রশিদ দেয়া হবে না, সেহেতু টাকা কিছুটা কম নেন- এমন অনুরোধেও কম নিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। কথার একপর্যায়ে নিজের পরিচয় দেয়ার পর তৎক্ষণাৎই ঘুষ গ্রহণ ও বিনা রশিদে টাকা নেয়ার কথা বেমালুম অস্বীকার করে বসেন মামুনুর রহমান। একইভাবে অস্বীকার করেন রশিদ প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা কর্মচারীসহ আরও দু’জন। একইভাবে আরও অন্তত কয়েক ডজন গ্রাহককে বিনা রশিদে টাকা নিয়ে ম্যাপ ও পর্চার কপি সরবরাহ করতে দেখা গেছে।

রশিদ দেয়ার দায়িত্বে থাকা এক মহিলা কর্মী ও মামুনুর রশিদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, প্রতিদিন এভাবে দেড় শতাধিক গ্রাহকের সমাগম হয়। এসব গ্রাহকের অধিকাংশেরই আরএস, বিএস, সিটি ম্যাপ এবং পর্চাসহ একাধিক কপির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ওইদিন আবেদন গ্রহণের নির্ধারিত সময় শেষে বিকাল সাড়ে ৩টায় মাত্র ৩২ জনকে রশিদ প্রদান করতে দেখা গেছে। আবেদনের সর্বশেষ ক্রমিক ছিল ৩৭২০ নম্বর।

গাড়ি থেকে নেমে এক কর্মকর্তা অধিদপ্তরে প্রবেশের সময় এক নারী গ্রাহক রশিদ ছাড়া টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেন। দেখিয়ে দেয়ার জন্য ওই কর্মকর্তাকে সে কক্ষে নিয়ে যেতে চাইলে কর্মকর্তা যেতে উদ্যত হন। পরক্ষণেই উল্টো ফিরে ভেতরে ঢুকে যান ওই কর্মকর্তা। মহিলা তার পিছু নিলে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি গেইটে থাকা খাকি পোশাক পরা অপর কর্মচারী। পরে ভেতরে গিয়েও ওই কর্মকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের ১৯ জোনের মধ্যে প্রতিদিন ঢাকা জোনের ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ জেলার মানুষ ওই অধিদপ্তরে এমন বাজারদরে প্রকাশ্য ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন।

একইভাবে ভূমি সংক্রান্ত অন্যান্য সেবা গ্রহণেও চলছে ঘুষের বাহার। জমির নামজারির-ফি আড়াইশ’ টাকার সঙ্গে আর মাত্র ২০ টাকা কোর্ট-ফি যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও তেজগাঁও ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা এই সেবা দেয়ার জন্য ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। একইভাবে রেজিস্ট্রি-ফি দাবি করে প্রতি লাখ টাকা মূল্যের বিপরীতে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। তবে তারা নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আরও কিছুটা কমে কাজ করে দেয়ার সম্মতি জানায়।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবদুুল জলিল বলেন, এই কার্যালয়ে ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে সমূলে উৎপাটন করতে পারিনি। তা কঠিনও বটে। পদ্ধতিগত পরিবর্তন ও অনলাইনে সেবা সরবরাহের মাধ্যমে দুর্নীতি ও গ্রাহকের হয়রানি কমানো সম্ভব। আমরা সেই সক্ষমতার দিকে এগুচ্ছি। তবে ঘুষের সঙ্গে বিনা রশিদে ম্যাপ ও পর্চা সরবরাহ করে সরকারি টাকাটাও মেরে দেয়ার বিষয়টি এই প্রথম জানলাম। আপনি ওই কক্ষে বসে থাকা অবস্থায় জানালে হাতে-নাতে ধরা যেত। তবে কর্মচারীর পরিচয় দিয়ে টাউটরা তা করতে পারে।

শুধু ভূমি খাতে নয়। অন্যান্য খাতে ও অফিস-আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমরমা ঘুষ বাণিজ্য এবং ঘুষের প্রকাশ্য ও প্রচলিত বাজারদর সম্পর্কে। ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে ব্যবসায় লাইসেন্স নিতে অতিরিক্ত ২০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। থানায় বিনামূল্যে সাধারণ ডায়েরি করার সেবা নিতে দিতে হচ্ছে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করতে ৩ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা, আমদানি সনদের ২০ হাজার থেকে এক লাখ, রপ্তানি সনদের ঘুষের বাজারদরও প্রায় একই, বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদনের জন্য অতিরিক্ত গচ্চা দিতে হয় ৫ হাজার ২০ হাজার টাকা। রাজধানীর অগ্রসর কোন স্কুলে ভর্তির জন্য লাগে ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। কারাগারে স্বজনদের দেখতে লাগে ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা। তা দেয়া না হলেও ওই বন্দির অবস্থানের কারা ওয়ার্ড নম্বর জানা থাকলেও তাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না।

এছাড়া নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতির জন্য ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ, সরকারি চাকরির ৪০ হাজার থেকে ১০ লাখ, পুলিশের চাকরি ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ, পুলিশ ভেরিফিকেশন সনদ পেতে ৫০০ থেকে দেড় হাজার, পুলিশের বদলি ৫০ হাজার থেকে ৩০ লাখ, পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করাতে ৫০০ থেকে ৫০ হাজার, বাড়ির প্ল্যান পাস করাতে ৩০ হাজার থেকে ৬ লাখ, সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ১০০ থেকে ২ হাজার, ফৌজদারি মামলার মেডিকেল সনদ ৫ হাজার ৪০ হাজার টাকা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা। রেলওয়ের বিভিন্ন কর্মচারী পদে চাকরির জন্য লাগে ২ থেকে ৬ লাখ টাকা। কয়েক বছর আগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধার ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের চেয়ে এখন বেড়েছে রেলওয়ের চাকরি প্রদানের ঘুষের বাজারদর। পাসপোর্ট করাতে অতিরিক্ত গুণতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায় মিলে অবৈধ পাসপোর্ট। কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত মেডিকেল সনদ মিলছে না বিদেশ গমনেচ্ছুদের অর্ধেকের বেশি মানুষের। ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে অতিরিক্ত গুণতে হচ্ছে ২ থেকে ৬ হাজার টাকা।

চট্টগ্রামসহ বন্দরগুলোতে আমদানিকৃত পণ্য খালাসে লাগে ১৫ থেকে ২০ হাজার, হাউজ লোন পেতে হাতডালি দিতে হচ্ছে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে ২ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আতিউর রহমান বলেন, কোন ব্যাংক যদি চাকরি প্রার্থীদের আবেদনের ক্ষেত্রে ফি হিসেবে টাকা-পয়সা নেয়, তাহলে সেই ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি কোন ব্যাংক এখনও টাকা নিয়ে থাকে তাহলে নামসহ অভিযোগ করলে জড়িত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালতে নিয়োগ ও গ্রাহক সেবার বিপরীতে ঘুষের নানা অংকের বাজারদর প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই এ রকম প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের বহু দৃশ্য চোখে পড়ে। চোখ-কান খোলা রেখে ঘণ্টাখানেকের অপেক্ষায় চোখে পড়তে পারে যে কারও। তবু ঘুষখোরদের হাতেনাতে ধরার জন্য তেমন ফাঁদ পাতছে না দুর্নীতি দমন কমিশন। ঘুষের তেমন অভিযোগও পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয় রাজধানী ঢাকায় হলেও চলতি বছর রাজধানী ও ঢাকা জেলায় ফাঁদ পেতে হাতেনাতে ঘুষ লেনদেনের সময় কোনো ঘুষখোরকেই ধরা হয়নি। সারা দেশে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য চললেও পুরো দেশেই এ বছর ফাঁদ পেতে ধরা ঘুষ লেনদেনের সংখ্যা আধাডজনের বেশি মাত্র। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৩টি, নওগাঁ, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গায় ১টি করেসহ আরও বেশ কয়েকটি ফাঁদ পেতে ঘুষের লেনদেন হাতেনাতে ধরেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তারা। যা রমরমা ঘুষ বাণিজ্যের ব্যাপক উপস্থিতির তুলনায় একেবারে নগণ্য বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ঘুষ প্রায় ক্ষেত্রেই ধরা যায় না। কেউ ঘুষ খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠলেই তদন্ত করে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিই। ঘুষের নিয়মিত অভিযোগ ও মামলাগুলো তদন্ত করেও ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর বাইরে ফাঁদ পেতেও ঘুষখোর ধরা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরে বিভিন্ন সেবা প্রদান বা গ্রহণে ঘুষের প্রকাশ্য বাজারদর চালু হয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে অনেক সময় ফাঁদ পেতে ঘুষখোরকে হাতেনাতে ধরা হচ্ছে। তবে এ বছর ঢাকার বাইরে হাতে-নাতে ঘুষ গ্রহণের সময় কয়েকজনকে ধরা হলেও ঢাকায় কাউকে ধরা যায়নি।-মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই