‘ঘাম নয়, রক্ত শুকালেও বেতন হয় না’

‘নিজেকে নিজেই বার বার প্রশ্ন করছি, আমরা কোন শ্রেনীর শ্রমিক যে – ১ মে শ্রমিক দিবসেও আমাদের ছুটি নেই, ৮ ঘন্টা জায়গায় ৯, ১০ ঘন্টা কাজ করতে হয়, ঘাম কেন শরীরের রক্তও শুকিয়ে যায় তবুও সময় মতো বেতন হয় না। তাই জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন, আমরা কেন শ্রেনীর শ্রমিক?’
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের ফেইসবুক লগইন করার সাথে সাথেই চোখে পড়ে এমনই একটি ট্যাটাস। এই স্ট্যাটাসটি আমাকে দারুণভাবে আহত করে তাই আজ দু’কলম লিখতে বসলাম।

এটি অন্য সাধারণ দিনের স্ট্যাটাসের মতো মনে হয়নি। সবাই হয়তো সহজেই বুঝতে পারছেন এই স্ট্যাটাসটি একজন শ্রমিকের। যিনি আজ শ্রমিক দিবসের সকালেও কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। আর হয়তো সেখান থেকেই তিনি এই স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন। তার এই স্ট্যাটাসের মধ্যেই ফুটে উঠেছে কর্মক্ষেত্রে তার কাজের সময়-সীমা ও পারিশ্রমিকের নিয়শ্চতার বিষয়টি।

ফলে এই শ্রমিক দিবসের সকালে এই স্ট্যাটাসটিই বলে দিচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থা কেমন! সেই ১৮৮৬ সালের ১ মে শ্রমিক আন্দোলনের প্রায় দেড়শ’ বছর পর আজ শ্রমিকদের অধিকার কতটা নিশ্চিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।

যতদূর জানা যায় তাতে, ১৯ শতকে কর্মসময়, বয়স, মজুরি আর শোষণ ও নিপীড়ন থেকে শ্রমিকদের আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবস ও বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে এই ১ মে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়, যা শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক লড়াইয়ের ঐক্যসূত্র প্রতিবছর মে দিবস বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্বের জানান দেয়।

কিন্তু এতো বছর পরও কী ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে? কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ হয়েছে, না কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে? না কোনটাই হয়নি। আজও আমাদের গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে ও পিষ্ট হয়ে নিহত হচ্ছেন অসংখ্য শ্রমিক। পুলিশের গুলি, সন্ত্রাসীদের ধর্ষণ ও নির্যাতনেও খুন হয়েছেন অনেকে। এছাড়া বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরিও সারা বিশ্বের তুলনায় সর্বনিম্ন। ফলে মাঝে মধ্যেই আমরা দেখতে পাই বিক্ষুদ্ধ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসলেই তাদের উপর চলে নির্যাতন, হামলা-মামলা। শ্রমিকরা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয়, বিদেশেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বিশ্বের ১৬০টি দেশে প্রায় ৯০লাখ বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। গেল বছরে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স ৬১.৯০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬২০০ কোটি মার্কিন ডলার।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৫ বছরে ২৪ লাখ ৫১,০৯৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৪২১৩ জন নারী কর্মী। সম্প্রতি সৌদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মীদের চাকুরির বাজার উন্মুক্ত হওয়ায় এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।

প্রতি বছর জনশক্তি রপ্তানির চাহিদা ৫০ লাখ। বিদেশে বৈধভাবে কর্মরত মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪%। আধা দক্ষ ও অদক্ষ জনসংখ্যার হারই প্রধান। নগণ্য সংখ্যক প্রফেশনাল ও দক্ষ জনশক্তি। ফলে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অন্যদিকে গার্মেন্টস শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটিরও বেশি শ্রমিক জড়িত। প্রতিবছর এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় গড়ে বিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও গার্মেন্টস শিল্প গত ৩০ বছরে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
নানা সঙ্কটের মধ্যেও এগুলো আমাদের আত্মস্লাগার সংবাদ। তবে সরকার এ নিয়ে যত গর্ববোধই করুক না কেন, এর পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ খুবই সামান্য।

প্রবাসী কর্মীদের প্রায় ৯০ ভাগই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত। গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। তারা যতটুকুই দক্ষতা অর্জন করে অবদান রাখছেন বেশীর ভাগই নিজ প্রচেষ্টায় দক্ষ হয়েছেন। এরপরও এসব কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশার ইয়ত্তা নেই। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বঞ্চনার সাক্ষীতো আমরা নিজেরাই। অন্যদিকে জাতিসংঘের তথ্যে বিশ্বে অভিবাসীদের সংখ্যা ২৩ কোটি ২০ লাখ। অভিবাসীদের ৫০ শতাংশই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ থেকে সহজেই বুঝা যায় আমাদের ৯০লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশের মাটিতে কেমন আছেন।

এদিকে বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণী মানুষের কর্মক্ষেত্র ক্রমেই সংকোচিত হয়েছে। আশির দশক থেকে অনেকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে আদমজী পাটকল। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলছেই। এছাড়াও বেসরকারি অনেক শিল্পকারখানাও বন্ধ হচ্ছে। ফলে আগামী দিনে আমাদের এই দেশে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত হবে, না আরো সংকোচিত হবে এটাই বড় প্রশ্ন। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়- এ কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে, রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

লেখক :

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান

কলাম লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]



মন্তব্য চালু নেই