গ্রামে এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিট দ্বিগুন বেড়েছে

এক দশক আগে গ্রামে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ২৩ লাখ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬ লাখ। এর মধ্যে ২৯ লাখেরও বেশি স্থায়ী এবং তিন লাখ অস্থায়ী অর্থনৈতিক ইউনিট। আর গৃহস্থালিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ইউনিট গড়ে উঠেছে ২৪ লাখ।

এই ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানিকীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। উত্তরাঞ্চলে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধিতে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে। বেড়েছে খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

অর্থনৈতিক শুমারি ২০১৩ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এই শুমারি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের বিবিএস-এর পরিসংখ্যান ভবন সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে শুমারির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কানিজ ফাতেমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামাল। এছাড়া অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক শুমারির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন। তিনি জানান, কৃষিবহির্ভূত সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এ শুমারির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একেকটি প্রতিষ্ঠানকে একেকটি ইউনিট হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

শুমারির ফলাফলে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবিকার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কৃষির বাইরে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। গ্রামে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন এখন আগের চেয়ে বেশি হচ্ছে। দেশের প্রায় ৭২ শতাংশ অর্থনৈতিক ইউনিট গ্রামেই গড়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক শুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ ও ২০০৩ এর শুমারিতে এ সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৮ হাজার ১৪৪টি। গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিট দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৩ সালে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ৩৭ লাখ।

এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ লাখ ৭৫ হাজার ৭০৪টি। এর মধ্যে অর্ধেক স্থায়ী ইউনিট। তবে এসব ইউনিটের ৯৯ শতাংশের বেশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর-জালের বাইরে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বৈষম্যের চিত্রও পাওয়া গেছে। এছাড়া এক দশকে গ্রামে ২৩ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিট থেকে বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ লাখ।

রিপোর্টে বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্পষ্টতর হলেও কর্মকাণ্ডের বৈষম্য এখনও রয়ে গেছে। জরিপে দেখা গেছে, বিভাগীয় শহরগুলোতে অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ইউনিট রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এরপর রয়েছে চট্টগ্রামে। সবচেয়ে কম ইউনিট সিলেট ও বরিশালে। এ ছাড়া খুলনা ও রংপুরে প্রায় ১০ লাখ অর্থনৈতিক ইউনিট গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩৭২টি, চট্টগ্রামে ১৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৭টি, রাজশাহীতে ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৩টি, রংপুরে ১০ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৫টি, খুলনায় ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮১টি, বরিশালে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ২৩৩টি এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৩টি।

অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোয় গত এক দশকে কর্মসংস্থান বেড়েছে ১১৭ শতাংশ। এসব ইউনিটে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে নারীদেরও অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রায় সাড়ে ৪০ লাখ নারী এসব ইউনিটে সম্পৃক্ত।

২০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১২ লাখ। অর্থনৈতিক ইউনিটের বৃদ্ধিতে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুমারির ফল থেকে দেখা গেছে, সেবা খাতের কার্যক্রম যেমন, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল মেরামত এবং খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা সর্বোচ্চ ৪৬ ভাগ স্থান দখল করে আছে।

ব্যবসা ও শিল্পায়নে ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি: ব্যবসা ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা শক্তিশালী ঊর্ধ্বগামী প্রবণতার সঙ্গে স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক ইউনিটের সর্বোচ্চ সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে।

১৯৮৬ সালে এর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৭৯৯টি। ২০১৩ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৩টিতে।

অর্থনীতির ভিত্তি ক্রমশ শক্তিশালী: বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানিকীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সময়ের ব্যবধানে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৯৮৬ সালে স্থায়ী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৯টি। ২০১৩ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৩৪ হাজার ৬১৬টিতে।

খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্রুত বিস্তার: দেশে খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ২০১৩ সালে খানাভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ৩৯ হাজার ৩৯৮টি। যা ২০০১ ও ২০০৩ সালে ছিল মাত্র ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৫টি।

গ্রামীণ অর্থনীতি বিকশিত: অর্থনৈতিক শুমারি ২০১৩ তে দেখা যায় যে, ২০০১ ও ২০০৩ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে শহর এলাকার তুলনায় গ্রামের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হয়েছে।

এ হার পল্লী এলাকায় ১৫০ দশমিক ৬০ ভাগ এবং শহর এলাকায় ৬২ দশমিক ৯০ ভাগ। একইভাবে রংপুরের দারিদ্রপীড়িত এলাকায় ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক কাযর্ক্রমে বাস্তব প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। এ বিভাগে ১৯৮৬ সালে অর্থনৈতিক ইউনিট ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ১৩৫টি। কিন্তু ২০১৩ সালে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৫টি।

সেবা খাতের অগ্রণী ভূমিকা: অর্থনৈতিক শুমারি ২০১৩ এর প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে সেবা খাতের কাযর্ক্রম যেমন মটরগাড়ি এবং মটর সাইকেল মেরামতসহ খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা সর্বোচ্চ ৪৫ দশমিক ৯১ ভাগ স্থান দখল করে আছে।

পরিবহণ এবং মজুদ ১৩ দশমিক ৬৫ ভাগ, অপরদিকে উৎপাদন ১১ দশমিক ৭৬ ভাগ এবং অন্যান্য সেবা কাযর্ক্রম ৮ দশমিক ৪৮ ভাগ।

প্রসঙ্গত, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৮৬ সাল থেকে অর্থনৈতিক শুমারি পরিচালনা করে আসছে। ২০১৩ সালে অর্থনৈতিক শুমারিসহ এ পর্যন্ত তিনটি শুমারি সম্পন্ন হলো।



মন্তব্য চালু নেই