গুলশান হামলায় যারা নিহত হয়েছেন
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় তিন বাংলাদেশি, এক ভারতীয়, নয় ইতালীয় এবং সাত জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছেন। তবে জাপানি নাগরিকদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশি, ভারতীয় এবং ইতালীয় নাগরিকদের পরিচয় জানা গেছে। ওই হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিচয় তুলে ধরা হলো:
গুলশান রেস্টুরেন্টে হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্প ব্যক্তিত্ব ইশরাত আকন্দ। নিজ দেশে তিনি শিল্পকলায় সোচ্চার ছিলেন এবং ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান ক্রিয়েটিভসের (আইএসি) তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে শিল্পকলা চর্চা করে আসছেন। বাংলাদেশের শিল্পকলা এবং চারুশিল্পীদের তিনি আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায় ২০০ শিল্পীকে নিজেদের প্রতিভা প্রকাশে সহায়তা করেছেন। তারা নিজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।
ইশরাত ইতালীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শুক্রবার গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় রাত পৌনে ৯টায় ওই রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় নিহত হন তিনি। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তার বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনরা। তার এক বন্ধু জানিয়েছেন, তিনি খুব অমায়িক ও ভালো বন্ধু ছিলেন।
ওই হামলায় নিহত ফারাজ হোসেইন (২০) সিমেন হোসেইন এবং মুহাম্মদ ওয়াকুয়ের বিন হোসেইনের ছোট ছেলে এবং ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি। ফারাজ অক্সফোর্ড কলেজ অফ ইমোরি ইউনিভার্সিটি থেকে এ বছর স্নাতক অর্জন করেন। তিনি ইমোরির গইজুয়েটা বিজনেস স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি মে মাসের ১৮ তারিখ গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ঢাকায় এসেছিলেন। দুই বন্ধুকে নিয়ে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেসময় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ফারাজ।
সন্ত্রাসীদের হামলায় অবিন্তা কবির (১৮) নামের এক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণী নিহত হয়েছেন। তিনি ইমোরি অক্সফোর্ড কলেজে লেখাপড়া করতেন। ২০১৯ সালে স্নাতক সম্পন্ন করার কথা ছিল তার। ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইফতারের পর বন্ধুদের সঙ্গে নৈশভোজের জন্য হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন অবিন্তা কবির। সেখানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন তিনি।
গুলশানের রেস্টুরেন্ট হামলায় যে নয়জন ইতালীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন তারা হলেন:
নাদিয়া বেনেদেত্তি (৫২) বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্টুডিওটেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর লন্ডনে অবস্থিত। এর ঢাকার শাখা অফিসেই ছিলেন নাদিয়া। নাদিয়ার মৃত্যুতে তার ভাইয়ের মেয়ে নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলেন, এখন আমরা শেষ ভরসাও হারিয়ে ফেললাম। আমার ফুফু নাদিয়া বেনেদেত্তি শুক্রবার বাংলাদেশের এক ভয়াবহ হামলায় নিহত হয়েছেন। আমরা আর কেউ একে অপরকে দেখতে পারব না।
তিনি তার বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কেউ তাকে ভুলে যাবেন না। যা কিছু ঘটল তা ভুলবেন না। আর এসব উন্মাদ লোকরা যেন আর এ ধরনের অন্যায় করতে না পারে। এদের জয়ী হতে দেবেন না।
ক্লাউডিও কাপেল্লি (৪৫) ভেদেনো ইতালির মোনজা প্রদেশের আল লামব্রো এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নিজের একটি টেক্সটাইল কোম্পানি চালাচ্ছিলেন। এ দেশে কাজ করে খুব খুশি ছিলেন তিনি। তিনি সবসময় বলতেন, কাজের জন্য এ দেশের পরিবেশ খুবই উপযোগী। ক্লাউডিওর মৃত্যুতে তার বোন বলেন, এটা আমাদের জন্য সত্যিই খুব দুঃখজনক। আমরা কখনো ভাবিনি এমন কিছু ঘটবে।
ভিনসেনজো দাল্লেসত্রো (৪৬) ইতালির পিয়েদিমোনতে মাতেসের কাসেত্রার নাগরিক। তিনি ১৯৯৩ সালে গ্লোসোপের নাগরিক মারিয়াকে বিয়ে করেন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
ক্লাউদিয়া মারিয়া ডি এন্তোনা (৫৬) ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ওই ইতালীয় টেক্সটাইল কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছিলেন। তিনি এবং তার স্বামী ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বাস করছিলেন। ওই হামলায় ইতালীয় নাগরিকদের মধ্যে একমাত্র মারিয়ার স্বামী গিয়ান গালিয়াজ্জো বোসছেত্তিই সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। তারা দুজন হলি আর্টিসানে নৈশভোজে অংশ নেন। পরে হামলায় মারিয়া নিহত হন এবং গিয়ান পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
সিমোনা মোনতি (৩৩) সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তিনি তার সন্তানের জন্মের পূর্বে ইতালি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই গুলশানের হামলায় নিহত হলেন তিনি। সিমোনা রোম থেকে কিছু দূরের মাগলিয়ানো সাবিনো শহরে বাস করতেন।
আদেলে পুগলিসি (৫০) ইতালির ক্যাটেনিয়ার নাগরিক। তিনি শনিবার নিজের দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। আদেলে আর্টসানায় একটি টেক্সটাইল গ্রুপের মাননিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন।
ক্রিসটিয়ান রোজি (৪৭) ফেলেত্তো আমবারতো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিন বছরের জমজ কন্যা সন্তানের বাবা ছিলেন ক্রিসটিয়ান। বৃহস্পতিবার ইতালি ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন তিনি। ফিবরেস লিমিটেড নামে তার নিজের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং চীনে তার এই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
মারিয়া রিবোলি (৩৩) স্বামী এবং তিন বছর বয়সী মেয়ে নিয়ে ইতালির সোলজায় বাস করতেন। তিনি ব্যবসায়িক কাজে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি একটি টেক্সটাইল কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। শুক্রবার রাতে গুলশান রেস্টুরেন্টে হামলায় নিহত হন মারিয়া।
গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলায় মারকো তোসদাত নামে আরো এক ইতালীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। তিনি টেক্সটাইলের একজন তরুণ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি স্টুডিও টেক্স লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। ব্যবসার কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি।
হলি আর্টিসান হামলায় তারুসি জেইন (১৮) নামের এক ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ছাত্র ছিলেন। এ বছর ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের আওতায় বাংলাদেশে ইবিএল বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ সম্পর্কে একটি প্রজেক্ট তৈরি করায় তাকে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। তার বাবা সঞ্জিব জইন ঢাকায় ২০ বছর ধরে গার্মেন্টস ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
গুলশান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় সাত জাপানি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে পাঁচ পুরুষ এবং দুই নারী। এরা হলেন- তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো।
এদের মধ্যে ছয়জনই মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ওই হামলায় আরো এক জাপানি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মন্তব্য চালু নেই