গায়ের রঙ কালো বলেই প্রাণ দিতে হলো শিক্ষিকা সুমিকে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন শাম্মী আক্তার সুমি (৩০)। প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স পাস করেন। ছিলেন নাট্যকর্মীও। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কর্মজীবনে। অংকন শেখানোর পাশাপাশি সুমি একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন। তবে স্বামীর কথায় সেই ব্যবসা গুটিয়ে যোগ দেন শিক্ষকতায়। চাকরি নেন মিরপুরের মনিপুর স্কুলের অংকন শিক্ষিকা হিসেবে। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন সহপাঠী হাবিবুর রহমান সুমনকে (৩০)। তাকে নিয়ে সুখের সংসার শুরু করেছিলেন প্রাণবন্ত মেয়ে সুমি। তবে সেই স্বপ্নের সংসারেই প্রাণ দিতে হলো তাকে! অপরাধ ছিল একটাই- সুমির গায়ের রঙ কালো। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রায়ই সুমিকে শোনাতো সেই কথা। গলাটিপে হত্যা করে তার মা হওয়ার স্বপ্নকে। একে একে চার বার সুমির গর্ভের সন্তান নষ্ট করেছিল পাষণ্ড স্বামী। জড়িয়ে পড়ে আরেক নারীর সঙ্গে পরোকিয়া সম্পর্কে। শেষ পর্যন্ত সুমিকে ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণাই দেয় স্বামী সুমন। এই মানসিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে শেষে নিজেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সুমি।
রাজধানীর মিরপুরে মনিরপুর স্কুলের শিক্ষিকা সুমির রহস্যঘেরা মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সুমির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং ডায়েরিতে মিলেছে দীর্ঘদিনের মানসিক নির্যাতনের অনেক আলামত। গত ৫ জুলাই মনিপুরের ভাড়া বাসা থেকে সুমির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই সুমির বড় বোন সেলিনা বেগম মিরপুর থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সুমনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ১৫ জুলাই সুমনকে দাউদকান্দি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে গত দুই মাসেও শেষ হয়নি চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকাজ। এখনো পাওয়া যায়নি ময়নাতদন্তের রিপোর্ট।
সুমির স্বজনরা অভিযোগ করছেন, সুমন ও তার পরিবারের লোকজনের মানসিক নির্যাতনে সুমি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। তার এই মৃত্যুর জন্য সুমন স্পষ্টতই দায়ী। তবে আইনজীবীর ছেলে সুমনকে রক্ষা করতে এখন একটি মহল উঠে-পড়ে লেগেছে। আত্মহত্যায় প্ররোচণার অনেক আলামত থাকলেও তদন্তকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা চলছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত চলছে। আমরা আসামি গ্রেপ্তার করেছি। তবে এখনো ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যার প্ররোচণার তেমন কোনো আলামত আমরা পাইনি। তবে বাসার মেইন গেটটি বাইরে থেকে বন্ধ ছিল।’
সুমির বড় ভাই সোবহান বাচ্চু বলেন, ‘সুমনের সঙ্গে সুমির অশান্তি শুরুর বিষয়টি সুমনের পরিবারও খুব ভালভাবেই জানতেন। এক বন্ধুর সঙ্গে ফেসবুক চ্যাটিংয়ে এ নিয়ে সুমির দীর্ঘ আলোচনার স্ক্রিন শটও আছে। সুমনের পরকীয়ার তথ্যও আছে। সুমনের মা সুমির বোন সুখির কাছে ঘটনার দিনও বলেছেন, সুমি তাকে বলেছে ‘আমি তাহলে আপনাদের ছেড়ে চলেই যাই। আমাকে বরিশাল পৌঁছে দিয়েন।’
বাচ্চু আরো বলেন, ‘সুমিকে চার বার গর্ভের সন্তান নষ্ট করতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া সুমনের টিনটিন নামে একজন নারীর সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড বিমর্ষ থাকতো সুমি। এ নিয়ে বন্ধুদের কাছে অনেক আক্ষেপ করেছে।’
তিনি বলেন, সুমন ও তার স্বজনরা বলত- সুমনের বেবি প্রয়োজন হলে কোথাও থেকে ফর্সা ও স্বাস্থ্যবান বেবি দত্তক নেবে। সুমির গর্ভের সম্ভাব্য কালো ও রোগা বেবি তাদের দরকার নেই।
তবে সুমনের বাবা আইনজীবী আব্দুল মান্নান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সুমিকে কালো বলা বা তার গর্ভের সন্তান নষ্ট করা, এসব কিছুই আমরা করিনি। আর সুমনের কোন পরকীয়া নেই। সুমি অনেক জেদি মেয়ে ছিল। সেই ধরনের কোন জেদ থেকেই আত্মহত্যা করতে পারে।’
এদিকে সুমির ফেসবুক ও ডায়েরিতে অনেক মর্মস্পর্শী আলামত পাওয়া গেছে। ফারহানা নাসরিন স্বাতী নামের একজনের সঙ্গে চ্যাটিং স্ক্রিন শটে সুমি লিখেছেন, ‘তোর ভাইয়ের প্রেম হয়েছে টিনটিন নামের এক মেয়ের সাথে…এটা নিয়ে ঝামেলা।’ গত বছরের ২১ জুলাইয়ের ওই চ্যাটিংয়ে দেখা গেছে, সুমি আরও লিখেছেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমাদের প্রবলেম চলছে, কাল ওই মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, ডিনার করে বাড়ি আসেনি, ফোনও বন্ধ রাখছে।’
গত ৩০ মার্চ একই ব্যক্তির সঙ্গে চ্যাটিংয়ে সুমি এও লিখেছেন, ‘আমি বোধহয় আর পারব না তোর ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে, সেও থাকতে চায় না’। নোটবুকে সুমি লিখেছেন, ‘…আমি নিজেকে এক জড়বস্তুর স্থানে নিয়ে এসেছি সুমনের জীবনে। আমি প্রবলেম ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না ওর জীবনে এটা এতদিনে বুঝতে পারলাম। কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে…।’ মা হওয়ার তীব্র ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘মা হতে চাই আমি…কি হাস্যকর এইসব ভাবি আমি…আমার যে কখনো মা হওয়া হবে না…’। লেখায় সুমি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বহুবার এমআর করানোর ফলে বন্ধ্যাত্বের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
স্বজনরা জানান, চার বছর আগে ২০১১ সালে তাদের সুমি ও সুমনের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার আগেই কোচিং সেন্টারে ক্লাস করার সময় থেকে ২০০৩ সালে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুমির বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। আর সুমনের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির পূজারভাঙ্গায়। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সুমন বড়। ছোট ভাই সুজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কমর্রত। আর বোন মুনিরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিক। ৩ ভাই ৪ বোনের মধ্যে সুমি সবার ছোট। সুমি চারুকলা থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স এবং সুমন অনার্স পাস করেন। সুমি লেখাপড়া শেষে রাজধানীর নাখালপাড়া এলাকায় পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। তবে সুমনের কথায় মিরপুরে চলে যান। চাকরি নেন মনিপুর স্কুলে।
মন্তব্য চালু নেই