গাজায় মানুষ নয় মানবতা খুন হচ্ছে, ত্রাণকর্তা কে?

রাজিউল হাসান :
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স যেবছর চৌদ্দ ছাড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চঞ্চল পনের’র দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেবছরের ঠিক মাঝামাঝি একটা দিন আমার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ দেখা সৌভাগ্য, না দূর্ভাগ্য- জানি না। বাবা-দাদাদের মুখে তার বিভিষীকার গল্প শুনে মনে হয়, না দেখেই ভালো হয়েছে। স্বাধীন বাংলাতে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা না থাকলেও অন্তত অকারণে মৃত্যুর যে আশঙ্কা একাত্তর সমসাময়ীক এবং এর আগের সময়গুলোতে যে হারে ছিল- তা আর নেই। আমি ভাগ্যবান, স্বাধীন-সার্বভৌম একটা দেশে জীবনের প্রথম শ্বাসটা নিতে পেরেছি। আমি ভাগ্যবান, আমি আমার স্বাধীন জন্মভূমিতে নিশ্চিন্ত শৈশব-কৈশর কাটিয়ে অনিশ্চিত যৌবনে উপনীত হতে পেরেছি। কিন্তু যখন ভাবি গাজার মানুষের কথা, তখন কেমন যেন কুঁকড়ে যাই। নিজের ভেতর বিদ্রোহ দানা বাঁধে। ইচ্ছে হয়, বর্বরতাকে বুলডোজার দিয়ে পিষে মারি। পাশ্চত্যের রঙিন জীবন যে আমার ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস তাড়িয়ে বের করতে চায়, গাজা তথা ফিলিস্তিনের মানুষের অনিশ্চিত জীবন সে শ্বাসকে ভাগ্যবানের শ্বাস বলে চিহ্নিত করে।

একদা আড্ডায় ঘুমের মাঝে স্বপ্নপ্রসঙ্গ উঠলে কখনো উদাস, আবার প্রসন্ন কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলতাম- আমি ছয়মাস-নয়মাসে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখার জন্য স্মৃতিতে যা থাকার দরকার, আমার হয়তো তা নেই। কিন্তু সেই আমার আজকাল চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্ন এসে হানা দেয়।

সেদিন স্বপ্ন দেখলাম- ঢাকা শহরের অর্ধেক বাড়িঘর, দালানকোঠা ভেঙ্গে চুরমার। বুঝতে পারছিলাম না, কেন এমন হয়েছে। আমি ভাঙ্গাচোরা রাজপথে হাঁটছি। সূর্যের কড়া রোদ নাকে-মুখে-চোখে ক্রিমের মতো মিশে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে আমাকে সেদ্ধ করে ফেলতে সূর্য প্রানপণ প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ! বেশ দূরে সায়েন্সল্যাবের ওখান থেকে শব্দটা এসেছে। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা যুদ্ধবিমান উড়ে গেল। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। কালো ধোঁয়া। মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। হঠাৎ বাবামায়ের কথা মনে পড়ল। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ফোন করতে গিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই! বাবামায়ের চিন্তায় কুঁকড়ে গেলাম। ওরা কি বেঁচে আছে? ওরা কি সুস্থ-নিরাপদ আছে?

পথ চলছি। কিভাবে যেন ধানমন্ডি লেকের কাছে চলে গেছি আমি চিন্তার সাগরে ভাসতে ভাসতে। মসজিদটার সামনেই রাস্তায় একটা শিশুকে পড়ে থাকতে দেখলাম। মাথাটা অর্ধেক গোলার আঘাতে নেই! তাকে সৎকার করারও কেউ নেই! তার পরিচয় দেয়ার মতোও কেউ নেই!

আবার কয়েকটা বিমান। খুব কাছেই আবারো গোলাবর্ষণ। আচ্ছা, আমার বাবামা কি বেঁচে আছে?

স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল কাঁদতে কাঁদতে। অনেকদিন পর পাথর চোখে জল গড়াল সেদিন!

আবার একদিন স্বপ্ন দেখলাম- আমি এমন এক রাস্তায় হাঁটছি, যার দু’পাশেই গাছপালার হাট। পরিবেশটা ঠিক গাজীপুর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সেনাবাহিনী ক্যাম্পটার দিকে যাওয়ার রাস্তার মতো। একা হাঁটছি। তবে হৃদয়ে কীসের যেন আনন্দ। একাকীত্ব আমাকে বিষাদগ্রস্ত করতে পারেনি। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে রাস্তা ফুঁড়ে এক সাবমেরিন টাইপ দানবীয় যান্ত্রিক কিছু একটা জেগে উঠল। জলের যন্ত্র কী করে স্থল ফুঁটো করে এই অরণ্যের পথে আমার সামনে, কিছুতেই মাথায় আসছিল না। যন্ত্রের পেট থেকে বেরিয়ে এল দু’জন রক্ত-মাংসের মানুষ। কী বলল- কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্বপ্ন খুব সম্ভবত লাফ দিল খানিক দূরে। অনেকটা ছায়াছবির রিল কাটলে যেমন হয় আরকি। আচমকা দেখি, আমি সেই যান্ত্রিক দানবের হর্তাকর্তা বনে গেছি। আমাকে বহনকারী সেই দানববের চাকা গজিয়েছে। তার পেছনে ট্যাংক-কামানসহ বিশাল সেনাবাহিনী। মাথার ওপর আকাশে উড়ছে শত শত যুদ্ধবিমান। স্বপ্নের মাঝেই পরিস্থিতি আমাকে ভীষন ভাবিয়ে তুলল। কাকে বা কোন দেশ আক্রমণ করতে যাচ্ছি- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি কে, তাও মাথায় আসছিল না। চিন্তা করতে করতে যখন আর মস্তিষ্ক কাজ করছিল না, হঠাৎই ঘুম ভেঙ্গে গেল।

প্রতিদিন অফিসে বসে যখন গাজার প্রতিবেদন লিখি, সবার দৃষ্টির আড়ালে চোখের কোণে জল জমে। জল লুকানো যখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, ডেস্ক থেকে উঠে যাই। হয় ওয়াশরুমে গিয়ে নোনা জলের ওপর ঢাকা ওয়াসার জলের ঝাপটা দেই, নাহয় বাইরে ঘোরাঘুরি করে বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে আসি বিষন্নতা।

কি নিষ্পাপ শিশুগুলো বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে সেখানে! তারা এমন ভাবে মরছে- যেন তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করার আগেই মরবে। তারা এমনভাবে মরছে- যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেনই গোলার আঘাতে মরতে। তারা এমনভাবে মরছে- যেন ওদের বাঁচার কোনো অধিকারই নেই! শুধু শিশু কেন- সাধারণ মানুষ যেভাবে মরছে, যেন তারা কেমনভাবে মরতে হয় তা বিশ্বকে দেখাতে মিছিলে নেমেছে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গাজায় ১৭২ জন মারা গেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, এর ৭৭ শতাংশই সাধারণ মানুষ। ৮০০ ফিলিস্তিনি দ্বৈতনাগরিক বলে গাজা ত্যাগ করে প্রান বাঁচাচ্ছে। ৪ হাজার ফিলিস্তিনি দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানর লড়াইতে নেমেছে। ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি জাতিসংঘের কাছে স্মরণার্থী আশ্রয় কামণা করেছে।

হাস্যকর লাগে, যখন জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয় শান্তি প্রতিষ্ঠায়। অথচ এই জাতিসংঘ ১৯৪৯ সালে জোরপূর্বক ফিলিস্তিনে ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, সাধারণ সভায় সদস্যপদ দিয়ে অশান্তি বুনেছিল। হাস্যকর জাতিসংঘের পক্ষপাতিত্বমূলক শান্তি প্রচারণা। ১৯৪৯ সালের আগে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলিরা ছিল উদ্বাস্তু, সেই ভূখণ্ডে এখন ফিলিস্তিনিরাই উদ্বাস্তু। এযেন নিজ দেশে পরবাসীর মতো অবস্থা! আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাও তো এমন কারণেই হয়েছিল, তাই না? আমাদের ভূখণ্ড দখল করতে এসেছিল আল্লাহর তথাকথিত সাচ্চা বান্দা পাকিস্তানি মুসলিমরা।

পাকিস্তানি সাচ্চা বান্দারা খুন-ধর্ষণ সবই জায়েজ মনে করেছিল, আর তাদের পা চাটা কুকুরগুলোও তাই বিধান মনে করেছিল। সেই কুকুরগুলো এখনো বিদ্যমান। কই পাকিস্তানি সাচ্চা বান্দারা তো ফিলিস্তিনে মুসলিমদের এই পরিণতিতে কিছুই বলছে না! এদেশে পাকিস্তানি সাচ্চা বান্দাদের রেখে যাওয়া উত্তরসূরিরাও দেখি একদমই নীরব। এরা ধর্মকে যে শুধুই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে, এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে?

ধর্ম বাদ। আমি সর্বদাই এপ্রসঙ্গ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ ধর্ম প্রসঙ্গ মাঝে মাঝে মানবতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেউ বুঝতে চায় না- মানুষই যদি না বাঁচে, ধর্ম বাঁচবে কি করে? এই কথা কোনো ধর্মের গোড়া ঈমানদারের মাথায়ই প্রবেশ করবে না। সৃষ্টিকর্তা নাকি বখিলদের হৃদয়ে সিল লাগিয়ে দেন এমনভাবে, যাতে সে হৃদয়ে আর কখনো ধর্মের আলো প্রবেশ না করে। একইভাবে আমার ধারণা- তথাকথিত ঈমানদারদের হৃদয়েও তিনি এমনভাবে সিল লাগিয়ে দেন, এরা হয়ে যায় মৌলবাদ। এরা তখন মানুষ বাঁচুক আর না বাঁচুক, ধর্ম বাঁচাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। একটাবার ভাবে না, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম!

সে যাই হোক। আরো এক ধরণের চিটার-বাটপাড় দেখি মাঝে মাঝে। এরা হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী। যেকোনো ইস্যুতে এরা মানবতাকে বাঁচাতে সামনে এগিয়ে আসে, মানুষের দ্বারে হাত পাতে মানবতাকে বাঁচাতে- সরল বিশ্বাসে মানুষ সাহায্যের হাত বাড়ায়, তারপর এরা নাই হয়ে যায়। রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির সময় এদের ব্যবসা করতে দেখেছি, এর আগে পরেও দেখেছি। এবারো দেখছি। সবে শুরু হয়েছে। সেদিন ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম, বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি দূতাবাস নাকি সাহায্য কামণা করেছে এবং তারা ফান্ড নিচ্ছে। সত্যতা যাচাইয়ে ওদের দেওয়া ফোন নাম্বারেই ফোন করলাম, কিন্তু কেউই রিসিভ করে না। আমার এক কলিগ আজ জানাল, যে ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দেওয়া হচ্ছে, তা ম্যাচ করছে না। এসব কি রে ভাই? গাজায় মানুষ মরছে আর তাকে ইস্যু করে আমাদের দেশে শুরু হয়ে গেছে চিটারি-বাটপাড়ি! আমরা কি মানুষ!

সবশেষ বলে কোনো কথা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবু শেষ করতে হয়, যবনিকা টানতে হয়। আমাকেও টানতে হবে। গত একসপ্তাহ ধরে গাজার মানুষের পরিণতি বিষয়ে কত কিছুই না লিখলাম সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে। মনেপ্রাণে চাইছি- মানবতার জয় হোক। আর তাই রুশ প্রেসিডেন্ট যখন গত শুক্রবার ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিলেন, মনে মনে তাকে কুর্ণিশ করেছি। ভেবেছি- একজন অন্তত মানবতার জয়গানকে জানে। শুক্রবারের পর মাঝে আরো দু’দিন কেটে গেছে। আজকের দিনটাও শেষের পথে। জানি না, এই লেখাটা তৈরি করতে করতে কতজন ফিলিস্তিনি মারা গেলেন, কতজন আহত হলেন। এরচেয়ে বিভিষীকাময় আর কি হতে পারে- মানবজাতির একটা অংশ এই জাতির হাতেই নিষ্পেষিত হচ্ছে আর আমরা মানুষ হয়েই তা সহ্য করছি, কেউ সমর্থন করছি, কেউবা নিন্দা জানিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকছি। আমরা কি এমন বিশ্ব চেয়েছিলাম? কার কাছে প্রতিবাদ/অভিযোগ জানালে বন্ধ হবে আমার ভাইয়ের রক্তক্ষরণ? কে বাঁচাবে মানবতাকে?

বি:দ্র: মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।



মন্তব্য চালু নেই