গণপরিবহনে আবারও ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা

গণপরিবহন ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে আবারও। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী গ্যাসচালিত বাসের ভাড়া বাড়ানোর আবেদন করেছেন পরিবহন মালিকরা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বরাবর এ আবেদন করা হয়েছে সড়ক পরিবহন সমিতির পক্ষ থেকে। বাস্তবতা হলো, ৯০ ভাগের বেশি বাস এখন তেলে চলে। অথচ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ পরিবহন সংশ্লিষ্টসহ অনেকের। এছাড়া অটোরিক্সার ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (রিআরটিএ) চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করা হয়েছে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে এখন কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বিআরটিএ কর্মকর্তারাও বলছেন একই কথা। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া চিঠির অনুলিপিও আসেনি বিআরটিএ সদর দফতরে। যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর দাবি অযৌক্তিক। জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে তারা গণপরিবহনের ভাড়া না বাড়াতে সরকারের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভাড়া বাড়ানোর আবেদনের পর থেকেই তা বাস্তবায়নে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাছাড়া সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি হলেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। ভাড়া বৃদ্ধির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা একাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক বলেও জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, এ পর্যন্ত যতবার পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে ততবার মালিক সমিতির দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকার।

পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর আবেদন না পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, আবেদন পাওয়ার পর আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভাড়া নির্ধারণ করার জন্য বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি রয়েছে। এতে সরকার, বিআরটিএ এবং মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। এই কমিটি বাস পরিচালনার ব্যয় বিশ্লেষণ করে ভাড়া নির্ধারণ করবে।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩৫ টাকা। আগামী ১ মার্চ থেকে সমপরিমাণ গ্যাসের দাম হবে ৩৮ টাকা। ১ জুন থেকে হবে ৪০ টাকা। দুই দফায় পরিবহনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়তে চলেছে প্রায় ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। গ্যাসের এ বর্ধিত দাম কার্যকর হওয়ার আগেই পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর আবেদন করেছেন মালিকরা।

সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গত সপ্তাহে জানান, বাস ভাড়া বাড়ানোর জন্য সমিতির আবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমানকেও অনুলিপি দেয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেন, শুধু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নয়- গত দেড় বছরে যন্ত্রাংশ এবং বাসের পরিচালনা ব্যয়ও বেড়েছে। যন্ত্রাংশ আমদানিতে বেড়েছে ট্যাক্সও। বাড়ছে দেশীয় যন্ত্রপাতির দাম। বাড়ছে শ্রমিকদের বেতনও। সব মিলিয়ে বাস পরিচালনায় কষ্ট হচ্ছে। পরিবহন মালিকদের টিকে থাকার স্বার্থেই ভাড়া বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই আমরা আবেদন করেছি। এখন বিবেচনা সরকারের।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, বাস ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। রাজধানীর বাস ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হল। অথচ সরকার সমর্থক মালিক সমিতির মহানগর সভাপতি হিসেবে না জানার কারণ সম্পর্কে বলেন, আমি কয়েকদিন অসুস্থ ছিলাম। তাই খোঁজ খবর রাখি না। তাহলে একটি পক্ষ নিজ উদ্যোগে ভাড়া বাড়ানোর আবেদন করেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কোন কিছুই জানি না। মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও আমার জানা নেই।

২০১৫ সালে সর্বশেষ ভাড়া বাড়ানো হয় ॥ ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়। বর্তমানে রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী পাঁচ জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে গণপরিবহন হিসেবে চলাচলকারী বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা। মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা। তবে অধিকাংশ বাস এ ভাড়া মানে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো বাস ভাড়া আদায় ও বাড়ানো হচ্ছে। গত সপ্তাহে লাব্বাইক পরিবহন প্রতি স্টপেজে পাঁচ টাকা কোন ঘোষণা ছাড়াই বাড়িয়ে দিয়েছে।

চলছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বাস ॥ বিআরটিএর হিসেবে রাজধানীতে ১০৩ রুটে গণপরিবহন হিসেবে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা ছয় হাজার ৪৩৫টি। এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ গ্যাসচালিত। আগে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ ভাগ ছিল। গ্যাস পেতে লম্বা লাইন ও বাসের আয়ুষ্কাল বাড়াতে গত কয়েক বছরে অধিকাংশ বাস সিএনজি থেকে ডিজেলে রূপান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর ভাড়াও বাড়ানোর আবেদন করেছেন মালিকরা। পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, দিন দিন গ্যাসচালিত বাসের সংখ্যা কমছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নির্ধারিত সময় পর্যন্ত গ্যাস দেয়া হয়। তাছাড়া তেলের দাম হাতের নাগালে চলে আসায় এখন গ্যাসচালিত বাসের সংখ্যা ১০ ভাগও নেই। অথচ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলে একটি গোষ্ঠী ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারায় নেমেছে।

এদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও আভাস দিয়েছেন, বাসের ভাড়া বাড়তে পারে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, যখন গ্যাসের দাম বাড়ে তার একটা প্রতিক্রিয়া আছে। বিআরটিএর ভাড়া পুননির্ধারণ কমিটিতে সব পক্ষ বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি জানান, এমন উদাহরণও আছে, গ্যাসের দাম বেড়েছে কিন্তু ভাড়া বাড়েনি।

২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করে সরকার। ওই বছরের ১ অক্টোবর বাস ভাড়া কিলোমিটারে ১০ পয়সা বাড়ানো হয়। তখন ১৭টি পরিচালনা ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। ‘অবিশ্বাস্য ব্যয়’ নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠেছিল। ২০১৫ সালের ১ নবেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ভাড়া বাড়ে ৬০ শতাংশ।

আদায় হচ্ছে বাড়তি ভাড়া ॥ যাত্রী কল্যাণ সমিতি নামের একটি সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯৪ ভাগ অটোরিক্সাই মিটারে চলে না। দ্বিগুণের বেশি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৫ সালে সরকার কিলোমিটারে ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর পর মালিকরা তা না মেনে কিলোমিটারে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা পর্যন্ত বাড়ান। বর্তমানে যে ভাড়া নেয়া হয়, তা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার প্রায় দ্বিগুণ। এ পরিস্থিতিতে আবারও ভাড়া বাড়ানো হলে, অতীতের মতোই নৈরাজ্য হবে। সরকার ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ালে মালিকরা ২৫ থেকে ৩০ পয়সা বাড়াবেন।

নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি অযৌক্তিক দাবি করে বলেন, একদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হলে মানুষ সঙ্কটে পড়বে। তাছাড়া এখন ভাড়া বাড়ানোর কোন যৌক্তিক কারণ নেই। সর্বশেষ তেলের মূল্য কমার পর গণপরিবহনের ভাড়া কমানো হলেও ঢাকায় ভাড়া কমেনি। অথচ অনেক পরিবহন তেলে চলছে।

বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জানান, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সরকারী সিদ্ধান্তের আনুষ্ঠানিক চিঠি ও পরিবহন মালিকদের ভাড়া বাড়ানোর আবেদন কোনটাই এখনও পাননি তারা। চিঠি ও আবেদন পাওয়ার পর ব্যয়-বিশ্লেষণ কমিটির সুপারিশ এবং নিয়মনীতি যাচাই করে ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানোর চিন্তা আমাদের নেই।

ভাড়া বাড়ানোর দাবি অটোরিক্সায় ॥ বিআরটিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে শ্রমিক প্রতিনিধিরা অটোরিক্সার ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে চালক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও অটোরিক্সার ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সদস্য মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, ‘গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে মালিকদের ক্ষতি হয় না। কিন্তু চালকদের দিনে ৮০ টাকা ব্যয় বেড়েছে। গত দেড় বছরে জীবন নির্বাহের ব্যয় অনেক বেড়েছে। ২৮ টাকার চাল ৫২ টাকা হয়েছে। ভাড়া না বাড়ালে চালকরা আর মিটারে চলতে পারবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলাচল করে। প্রথম দুই কিলোমিটারে এর ভাড়া ৪০ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা। ওয়েটিং চার্জ প্রতি মিনিটে ২ টাকা করে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে।-জনকণ্ঠ



মন্তব্য চালু নেই