‘গণতন্ত্র মুক্তির’ নূর হোসেন দিবস আজ
মিছিলে-মিছিলে, স্লোগানে-স্লোগানে মুখর জিরো পয়েন্ট। চারিদিক থেকে আসছে অজস্র বিক্ষুব্ধ মানুষ। শত শত মানুষের মধ্যে এক জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেন। স্বৈরশাসকের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে বুকে-পিঠে লিখেছেন একটিই স্লোগান, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।
ওই জীবন্ত পোস্টার থেকে দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ছিল আন্দোলনের দাবানল। আগ্নেয়গিরির অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছিল সারা দেশে। কেঁপে কেঁপে উঠেছিল স্বৈরাচার এরশাদের মসনদ।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তার ক্ষমতার তক্তে আরোহন, সেই বন্দুক তাক করে দেয় নূর হোসেনের দিকে। এক মুহূর্তে স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী ঝাঁঝরা করে দেয় জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেনের বুক। ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তে মুছে যায় ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগানটি। মাটিতে লুটিয়ে পড়া নূর হোসেনের মুখে তখনও উচ্চারিত হয়, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক……… স্বৈরাচার নিপাত যাক……..’।
আজ সেই ১০ নভেম্বর । ১৯৮৭ সালের এই দিনে গণতন্ত্রের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল যুবলীগের কর্মী নূর হোসেন। গুলিতে আরো শহীদ হন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো।
নূর হোসেনের আত্মত্যাগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ঝড় তুলে দেয় সারা দেশে। আরো বেগবান হয় আন্দোলন-সংগ্রাম। এই হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সাধারণ মানুষ। তিন জোটের সংগ্রাম অপ্রতিরোধ্য রূপ লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বর জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন স্বৈরাচারী এরশাদ।
মহান আত্মত্যাগের জন্য দিনটিকে শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আজ ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস উপলক্ষ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ভোরে শহীদের মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ এবং জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন স্কয়ারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। এ উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হবে।
এ দিবস নিয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। পৃথকভাবে বাণী দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ।
এদিকে গণতন্ত্র উত্তোরণের ২৪ বছর আর নূর হোসেনের রক্তাক্ত অধ্যায়ের ২৭ বছর পর সেই পতিত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দাবি করেছেন, ওই দিনটিতেই তিনি গণতন্ত্র ঘোষণা করেছিলেন। যে কারণে দিনটিকে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এরশাদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর মহান জাতীয় সংসদে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভাষণ প্রদান করে সামরিক শাসন চির অবসানের ঘোষণা দিয়ে আমি বলেছিলাম, জনগণের প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের ভিত আজ রচিত হলো। যা কেউ কোনোদিন নস্যাৎ করতে পারবে না। সেই গণতন্ত্র আজো অব্যাহত রয়েছে বলে গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে ১০ নভেম্বর দিনটি গণতন্ত্র দিবস হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। এই দিনে আমি দেশের সকল গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ আছে এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ব্যহত হয়েছে। তবে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর আমি যে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছি কোনো ষড়যন্ত্র আর তাকে ব্যহত করতে পারেনি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি এই গণতন্ত্র অনাদিকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। গণতন্ত্র দিবসে এটাই হোক সকলের অঙ্গীকার।’
গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এরশাদ বলেন, ‘আমি বলতে চাই- গণতন্ত্র শুধু একদিনের ভোটের অধিকার নয়, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে হবে এর মাধ্যমে। তৃণমূল পর্যায় থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই হচ্ছে ১০ নভেম্বরের মূল মন্ত্র।’
স্বৈরাচারী এরশাদ যে বিবৃতিই দিক না কেন, এই দিনটি বাঙালির অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম স্বাক্ষর। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপরই এই গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন, বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। রক্ত দিয়ে লেখা এই দিনটি কখনোই বিবৃতি দিয়ে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া যাবে না। এমন মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
মন্তব্য চালু নেই