‘ওরা স্লিপার সেল ও লোন উলফ্’

খুনীরা একে অপরকে না চিনলেও হত্যায় অংশ নেয়

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হওয়ার পর ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে (২৬) দিন-দুপুরে রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে আবু তাহের, জিকরুল্লাহ (২০) ও আরিফুল ইসলাম (১৯) নামে তিন তরুণ। পুলিশ তাৎক্ষণিক খুনীদের ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থলের কিছু দুর থেকে জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে আটক করে। আবু তাহের পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আটকরা জানিয়েছে, তারা একে অপরকে আগে থেকে চিনত না। মাসুম নামে একজনের কথা শুনে তারা এ হত্যা মিশনে নামে। তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফুল প্রথমবারের মতো রবিবার বিকেলে হাতিরঝিলে মিলিত হয়। সেখানেই তারা এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা শেষে মাসুম সবাইকে বাবুর ছবি দেয় এবং তার বাসা চিনিয়ে দেয়। হত্যাকাণ্ডের মূল মিশনে অংশ নেয় তাহের। তাকে সহযোগিতার জন্য সঙ্গে যায় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম।

গোয়েন্দাদের ভাষায়, ‘জঙ্গি’দের এ ধরনের সদস্যদের ‘স্লিপার সেল’ বলা হয় এবং যিনি হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাকে ‘লোন উলফ্’ বলা হয়। স্লিপার সেল কোনো নির্দিষ্ট ‘জঙ্গি’ সংগঠনের না। যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মধ্যে এ বিভাগ থাকে। স্লিপার সেলের সদস্যরাও আসলে ‘জঙ্গি’ না। কোনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কয়েকজনের দায়িত্ব থাকে স্লিপার সেলের সদস্য সংগ্রহ করার। এ জন্য তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে সময় ব্যয় করেন এবং স্লিপার সেলের জন্য সদস্য সংগ্রহ করেন।

দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রথমে যাওয়া-আসার পথে তরুণ একজনকে টার্গেট (বাছাই) করেন। এরপর তার সঙ্গে তারা ভাল সম্পর্ক সৃষ্টি করে। তাকে ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। ক্রমেই টার্গেট ওই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর স্লিপার সেলের সদস্যে পরিণত হয়। স্লিপার সেলের একজন সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের কোনো ধরনের পরিচয় থাকে না। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়ার আগ পর্যন্ত স্লিপার সেলের সদস্যরা একে অপরের কাছে অচেনা থাকে। পরে যখন কোনো কিলিং মিশনের সময় হয় তখন স্লিপার সেলের দুই বা তিনজন সদস্য নিয়ে একটি গ্রুপ করা হয়। তাদের প্রত্যেককে একে-অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় পরিকল্পনাকারী। তবে স্লিপার সেলের সদস্যরা মিশনের আগে সামান্য পরিচিত হলেও একজন অন্যজনের সম্পর্কে তেমন তথ্য জানতে পারে না।

গ্রুপের প্রত্যেক সদস্যকে মিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হয় এবং কীভাবে খুন করতে হবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনাকারী নিজেই স্লিপার সেলের সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহ করে। তারা বেশিরভাগ সময় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। স্লিপার সেলের সদস্যদের নিয়ে যে গ্রুপটি করা হয় তাদের মধ্যে এমন একজনকে রাখা হয় যে কিনা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অভিজ্ঞ। তাকে ‘লোন উলফ্’(একক মুজাহিদ) বলা হয়। লোন উলফের সঙ্গে বাকিদের পাঠানো হয় অভিজ্ঞতা অর্জন ও কিলিং মিশনে সহযোগিতার জন্য। স্লিপার সেলের তরুণ সদস্যরা কিলিং মিশনে যাতে ব্যর্থ না হয় সেটা নিশ্চিতের দায়িত্ব থাকে লোন উলফের।

সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শী, আটকদের ও পুলিশের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ বেগুনবাড়ির বাবু হত্যার ঘটনার স্লিপার সেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল এবং লোন উলফের ভূমিকায় ছিলেন আবু তাহের। মাসুম ছিলেন পরিকল্পনাকারী। এই পরিকল্পনাকারী অনেকটা ছায়ার মত। কারণ তাদের সম্পর্কেও স্লিপার সেল সদস্যরা নাম ছাড়া আর কিছুই জানতে পারে না।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সোমবার দুপুরে আটক জিকরুল্লাহ  জানান, তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার কোরআনে তাফসিরের শিক্ষার্থী। মো. মঈনুদ্দিনের ছেলে জিকরুল্লাহ নরসিংদীর বাসিন্দা। গত রমজানের পর চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে প্রথম মাসুমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মাসুম তাকে বলেছিলেন, যে তিনি কক্সবাজার যাচ্ছেন। মাসুমের পোশাক, আচার-আচরণ ও কথা শুনে হয় জিকরুল্লাহ। এরপর থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। ইন্টারনেটে ‘প্রোটেক্টেড টেক্সটের’(সংরক্ষিত বার্তা) মাধ্যমে তারা যোগাযোগ করত।

জিকরুল্লাহ আরও জানান, মাসুমের কথা মত শনিবার ঢাকায় এসে যাত্রাবাড়ির একটি মসজিদে অবস্থান করে। পরে রবিবার হাতিরঝিলে প্রথম আরিফুল ও তাহেরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিন্তু সে তাদের নাম ছাড়া আর কিছুই জানত না। মাসুম তাদের সবাইকে নিয়ে হাতিরঝিলে পরিকল্পনা করে। বাবুর ছবি দিয়ে দেয় এবং বাসাও চিনিয়ে দেয়। মাসুম তাদেরকে বাবুর ছবি দেখিয়ে বলে যে, সে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ ও আমাদের নবী-রাসূলের নামে কটুক্তি করছে। তাকে খুন করা সোয়াবের কাজ। এ কাজের জন্য তারা বেহেশতে যাবে।

একই সময় আটক আরিফুল কুমিল্লার বাসিন্দা তাজুল ইসলামের ছেলে। আরিফুল  জানান, সে মিরপুর-১ এ দারুল উলুম মাদ্রাসার ইবতেদায়ির শিক্ষার্থী। মাসুমের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ফার্মগেটের একটি মসজিদে। মাসুমের পোশাক, আচার-আচরণ ও কথা শুনে সেও মুগ্ধ হয়। এরপর থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। ‘প্রোটেক্টেড টেক্সটের’ মাধ্যমে তারা যোগাযোগ করত। পরে বায়তুল মোকাররম জামে মসজিদে তাদের দ্বিতীয়বার দেখা হয়।

তিনি আরও জানান, মাসুমের কথা মত রবিবার হাতিরঝিলে দেখা করে সে বাকিদের সঙ্গে পরিচিত হয়। তবে নাম ছাড়া আর কিছুই সে জানত না। মাসুম তাকে বলেছিলেন, তুমি একটু দুর্বল তাই দাঁড়িয়ে দেখবে তাহের কীভাবে কাজ শেষ করে। তোমাকে পাঠাচ্ছি অভিজ্ঞতার জন্য। দেখে শেখ, পরে তোমাকেও করতে হবে।

আরিফুল বলেন, ‘আমরা সকাল ৯টা থেকে বাবুর জন্য অপেক্ষা করি। সাড়ে ৯টার দিকে বাবু বের হলে তাকে হামলা করি। আল্লাহ ও আমাদের নবী-রাসূলের নামে কটুক্তি করলে তাদের পরিণাম এমনই হবে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, আটকরা তাদের এ কাজের জন্য মোটেও অনুতপ্ত নয়। আরিফুলের চোখে ভয় থাকলেও, জিকরুল্লাহের চোখে একদমই ভয় ছিল না। সে একদমই শান্ত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি, তেজগাঁও) বিপ্লব কুমার সরকার  বলেন, হত্যা মিশনে তিন যুবক অংশ নেয়। তাদের প্রত্যেকের কাছে একটি করে চাপাতি ছিল। কিন্তু সেখান থেকে দু’টি চাপাতি ব্যবহার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে ব্যবহৃত দু’টি ও আরিফুলের ব্যাগের মধ্যে অব্যবহৃত একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বেগুনবাড়ি দিপীকার ঢাল থেকে সোমবার সকালে ওয়াশিকুরকে রক্তাক্ত অবস্থায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) হুমায়ুন কবির উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ওয়াশিকুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তার মতাদর্শ প্রচার করত। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে খুন করে আবু তাহের, জিকরুল্লাহ ও আরিফুল। রবিবার হাতিরঝিলে তারা এ খুনের পরিকল্পনা করে এবং সোমবার সকালে বাবু বাড়ি থেকে বের হলে অদূরেই চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আরিফুলকে খুন করে। তাদের তিনজনের কাছে তিনটি চাপাতি ছিল। বাবুকে তাহের বেশি কোপ দিয়েছে, তবে সে পলাতক রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে তাহের সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, ঘটনার আগে খুনিরা কেউ কাউকে চিনত না। ঘটনার একদিন আগে তাদের পরিচয় হয়। যাকে তারা খুন করেছে তাকেও চিনত না। মাসুম নামে একজনের কথায় তারা এ খুন করে। বাবু আসলেই ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছে কিনা তাও তারা দেখেনি। মাসুমের কথার ভিত্তিতেই এ খুন করে তারা।

তিনি আরও বলেন, ওয়াশিকুরের পকেট থেকে পাওয়া তার ভোটার আইডিকার্ড থেকে জানা যায়, তিনি লক্ষ্মীপুরের টিপু সুলতানের ছেলে। ঢাকার তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় ভাড়া থাকতেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে আটক জিকরুল্লাহ ও আরিফ খুনের কথা স্বীকার করেছে। তবে ব্যাগে ভরে নিয়ে আসা আরিফের চাপাতিটি খুনের সময় ব্যবহার করেনি। বাকি দু’জনই মূলত বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত আবু তাহের নামে আরেকজন অংশ নেয়। পুলিশের ধাওয়ায় সে পালিয়ে যায়। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে। ফেসবুক ও ব্লগসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অপ-প্রচারমূলক লেখালেখি করার কারণেই বাবুকে হত্যা করা হয়েছে বলে আটকরা দাবি করেছে।

নিহত ওয়াশিকুর রহমান বাবু গত প্রায় দেড় বছর ধরে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পাশে ফারইস্ট এ্যাভিয়েশন এজেন্সিতে ট্রেনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে দাবি করেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কুতুব উদ্দীন চৌধুরী।

এ প্রসঙ্গে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, এর আগেও খুনের কিছু ঘটনায় স্লিপার সেল ও লোন উলফের জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গিয়েছে। এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ খুনের ঘটনাতেও স্লিপার সেল ও লোন উলফ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই