আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে
খালেদার অনড় অবস্থানে আশাহত আ’লীগ
টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে এখন অনেকটাই হতাশ আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে গতকাল ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন থেকে কর্মসূচি প্রত্যাহারের কোনো ঘোষণা না আসায় আশাহত হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। খালেদা জিয়ার এ অনড় অবস্থানের সাথে নতুন করে পাঁচ দফা প্রস্তাব ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
গতকাল আলাপকালে দলের সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, দুই মাসের বেশি সময় ধরে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও- পোড়াও, নাশকতা ও হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী তৎপরতা আওয়ামী লীগের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। সর্বোচ্চ দমনপন্থা অবলম্বন, হামলা, মামলা ও আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানার পরও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপসহীন মনোভাবে চিন্তিত মতাসীনেরা।
এমন প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার গতকালের সংবাদ সম্মেলন আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারকদের মনে খানিকটা আশার সঞ্চার করলেও তা আর টেকসই হয়নি। কারণ, ক্ষমতাসীনদের ধারণা ছিল, ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে খালেদা জিয়া হয়তো চলমান অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার বা শিথিলের ঘোষণা দিতে পারেন। কিন্তু কোনো রকম ‘ব্যাকফুটে’ অবস্থানে না গিয়ে চলমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া সরকারকে আবারো একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এতে সারা দেশে চলমান নাশকতা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের বাইরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও কূটনীতিকসহ বিদেশীদের চাপের মাত্রাও আরো বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে বলে ক্ষমতাসীনদের মনে যে আত্মবিশ্বাস ছিল সেই বিশ্বাসে খানিকটা চিড় ধরেছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া অস্থিরতায় ইতোমধ্যেই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। টানা অবরোধ ও হরতালে দেশের অর্থনীতি গভীর খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মধ্যে নাশকতার ঘটনা কিছুটা কমে এলেও আবার হঠাৎ করেই সারা দেশে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে এমনিতেই দেশী-বিদেশী নানামুখী চাপের মুখে রয়েছে সরকার।
এ সময় যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যার ঘটনা ঘটছে, তেমনি মাঝে মধ্যে বিরতি দিয়ে বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। অন্য দিকে বারবার নির্দেশার পরও চলমান সঙ্কটের রাজনৈতিক মোকাবেলায় সারা দেশে ব্যাপক হারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে পারছেনা না আওয়ামী লীগ। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমনিতেই এক ধরনের অস্বস্তি ও হতাশা কাজ করছে। তার ওপর খালেদা জিয়ার কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা অবাক করেছে সবাইকে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা আলাপকালে বলেন, বিএনপি জোটের দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে বলে আমরা ভেবেছিলাম। সরকারবিরোধী নেতাকর্মীরা দুর্বল হয়ে পড়ায় সারা দেশে নাশকতার মাত্রাও কিছুটা কমে এসেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে অবরোধের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ থাকলেও রাত ৯টার পর আবার মহাসড়কে যানচলাচলের নির্দেশ দেয় সরকার। আমরা মনে করেছিলাম সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়া হয়তো গতকালের সংবাদ সম্মেলন থেকে অবরোধ-হরতাল শিথিল বা স্থগিত করে নতুন কোনো কর্মসূচি দেবেন। কিন্তু তা না করে জাতির সাথে আমাদেরও তিনি হতাশ করেছেন।
দলের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নেতা বলেন, নাশকতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান এবং দীর্ঘ দিন ধরে মাঠে থাকতে থাকতে নেতাকর্মীরাও কান্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার সরাসরি কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় আন্দোলন কিছুটা থমকে যায়। সে জন্য খালেদা জিয়াকে একাধিকবার গ্রেফতারের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে আবার পিছু হটে সরকার। আমাদের ধারণা ছিল, এভাবে আর কিছু দিন চললে হয়তো তাদের আন্দোলনের কবর রচনা হয়ে যাবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থান মুমূর্ষু নেতাকর্মীদের ‘অক্সিজেন’ জোগাবে। হারানো মনোবল ফিরে পেয়ে আবারো রাজপথে সরব হয়ে উঠবে সরকারবিরোধীরা। এতে আবারো দেশব্যাপী নাশকতার মাত্রা বেড়ে যেত পারে। বিষয়টি সরকারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। তাই আন্দোলন মোকাবেলার কৌশল নিয়ে সরকারকে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিদেশী তৎপরতা থাকলেও তা আর কত দিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা বলা মুশকিল। খালেদার অনড় অবস্থানে কূটনীতিকরা এখন আবারো সরব হয়ে উঠবেন। তখন কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তা বলা মুশকিল। বিশেষ করে এ মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এ আন্দোলন গতি পেলে তার আসাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বিষয়টি সরকারের জন্য খুব বিব্রতকর।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর সুব্রামানিয়াম ২ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাাতের সময় তাকে (জয়শঙ্কর) জানানো হয়, চলমান হরতাল-অবরোধে সহিংসতা ঘটাচ্ছে বিএনপি। এ সময় কোনো মন্তব্য না করে জয়শঙ্কর চুপ করে শুধু কথা শুনেছেন বলে জানা গেছে। আর জয়শঙ্করের চুপ থাকার এ বিষয়টিও আওয়ামী লীগে অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশে দুই মাস ধরে নাশকতা চলছে, জ্বালাও-পোড়াও চলছে। ফলে সরকারের ভেতর অস্বস্তির কারণ থাকছেই। আর খালেদা জিয়া ক্ষান্ত না দিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় সেই অস্বস্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেছে।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, বিএনপি জোটের আন্দোলনে দেশের মানুষের সাড়া নেই। তারা আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গি কার্যক্রম করছে। তিনি সেই কার্যক্রম থেকে বের হয়ে আসেননি। তাই সরকারের দায়িত্ব সন্ত্রাস দমন করা। সরকার তাই করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাস দমনে যা যা করার দরকার ভবিষ্যতে তা-ই করবে।
দলের আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দীপু মনি বলেন, খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করায় দেশের জনগণের কাছে ধিকৃত হয়েছেন। পুরো জাতি ভেবেছিল তিনি সেটি বুঝতে পেরে আন্দোলন থেকে সরে আসবেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে তার অবস্থান পরিবর্তন না করায় পুরো জাতি হতাশ হয়েছে। এখন তিনি গুলশানে বসে সেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে। পাশপাশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও রাজপথে থেকে তাদের সব ধরনের নাশকতা প্রতিরোধ করবে।
মন্তব্য চালু নেই