মাহফুজ আনামের মন্তব্য কলাম :

খালেদাকে আটকে রাখা বিপদের পূর্বাভাস

আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, শেখ হাসিনাও চিরদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। আগামী নির্বাচনে ক্ষমতার হাত বদল হতে পারে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ঘটে যাওয়া কিছু উদাহরণ অতীতের ঘটে যাওয়া উদাহরণের মতো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এগুলোর কারণে থমকে যাচ্ছে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা।

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে যে খুনের নজির তৈরি করা হয়েছিল তার পরিণতিতে আমরা অপরিমেয় দুর্গতি ভোগ করেছি। আর এ ঘটনার পরই আমাদের ফেলে দেয়া হলো সামরিক ও আধা-সামরিক একনায়কত্বের ভেতরে। তাদের দুর্ভাগ্যজনক ও অসংবিধানিক আচরণ ভোগ করতে হয়েছে অনেক খুন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এর সবগুলোই ছিল বিপদজনক নজির। এসব নজির দেখে আমরা ভাবলাম, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রকে জীবিত করবে।

আমাদের বিশ্বাস, আমরা এমন এক সরকার ও প্রশাসন পেয়েছি যারা সংবিধান, আইন, নীতি ও শিষ্টাচারের প্রতি অনুগত। আমাদের সদ্য বিকশিত গণতন্ত্র নিয়ে প্রত্যাশার জায়গায় প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৯২ থেকে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ডাকা বিরামহীন হরতালের মাধ্যমে। সংবিধানে অনুপস্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে শেষ দু’বছরে সপ্তাব্যাপী হরতালের ডাক দেয়া হয়।

আমাদের গণতন্ত্রের সংস্কৃতিতে আরেকটি আঘাত আসে আওয়ামী লীগের সংসদ বয়কটের মাধ্যমে। কয়েকদিনের বয়কট দিয়ে যেটা শুরু হয়েছিল সেটা শেষ হয় কয়েক মাসের অনুপস্থিতির মাধ্যমে। এ ধাক্কারই ধারাবাহিকতায় অপর এক ধাক্কা আসে গণহারে সংসদ থেকে আওয়ামী এমপিদের পদত্যাগের মাধ্যমে। আর তাতে বিরোধীদল শূন্য হয়ে পড়ে সংসদ। এতে শুরুতেই জাতীয় সংসদের বিকাশমান ভারসাম্যব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগ বিরোধীদল হিসেবে যে নজির স্থাপন করে পরবর্তী সময়ে তাকেই ‘মডেল’ হিসেবে মেনে নেয় ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া বিএনপি। তারা বিরোধিতার সবকিছুই অনুসরণ করেছিল। প্রতি মেয়াদে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মধ্যকার বৈরিতা কেবলই বেড়েছে। বছরের পর বছর তা অব্যাহত রয়েছে। ফলস্বরূপ আমাদের সংসদ ‘গণতান্ত্রিক সরকারে’র সম্ভাবনাময় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারছে না। কিন্তু এটা ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসম্মান করার মঞ্চে পরিণত হচ্ছে। উপরন্তু এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, নেতাদের নির্দেশে যত উগ্র কণ্ঠে ও নোংরা ভাষায় সংসদে কথা বলা যায়, ততই যেন ভালো।

দিনের পর দিন সংসদ বিরোধীদল শূন্য থাকায় সেটির কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে। আর এর ফলে সরকারকে জবাবদিহিতায় নিয়ে আসার মতো কিছুই থাকছে না। সংবিধানে নির্বাহী প্রশাসনকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর সময় ছাপিয়ে তা আরো বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে। আর এ চর্চার ফলে ভালো সরকারের জন্য ‘ভারসাম্যাবস্থা’র বিষয়টি পুরো হারিয়ে গেছে। আবারো লর্ড অ্যাকটনের উক্তিই সত্য প্রমাণিত হলো। তিনি বলেছিলেন, “ক্ষমতা নীতিভ্রষ্ট। অবাধ ক্ষমতা অবাধ নীতিভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যায়।” আর এ বাস্তবতার সঙ্গেই আমরা সবাই বাস করছি আজ।

এসব ধ্বংসাত্মক খারাপ নজিরের মধ্যে বিএনপিও আরেকটি প্রাণঘাতী খারাপ নজির যোগ করলো। আর সেটি হলো শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান ও ২৪ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের হত্যার ঘটনা। মর্মান্তিক এ ঘটনার পরও খালেদা জিয়া সরকার ছিল উদাসীন, তদন্তেও আন্তরিক ছিল না। আর এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, তৎকালীন সরকার বিষয়টা জানতো। তার দলের প্রভাবশালী একটা অংশ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সত্য ঘটনা কী, আশা করি তা আদালতের মাধ্যমেই বের হয়ে আসবে। কিন্তু হামলার ঘটনার পরপরই কিছু আলামত দ্রুত ধ্বংস করে দেয় খালেদা জিয়া সরকার, মামলার তদন্ত নিয়ে পুরোপুরি মন দিয়ে কাজ না করা- এসবকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটি শত্রুতার রেষই মনে করা হয়। তবে এ বৈরিতা জনমনে এমন অমোচনীয় ধারণাও তৈরি করে যে, বিএনপি কিংবা খালেদা জিয়া এ ঘটনা না ঘটিয়ে থাকলেও শেখ হাসিনা এ হামলার শিকার হলেও তারা খুব একটা অসন্তুষ্ট হতো না।

এসব ছাড়াও অতীতে আরেকটি বিপদজনক নজির দেখা গিয়েছিল। আর এটিতে আমাদের অতীত স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির তেমন কোনো বদল ঘটেনি। ১৯৭৫ সালের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর জিয়াউর রহমান এর ভূমিকাটি শেখ হাসিনা মেনে নিয়েছিলেন। আর এখন খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানকে রাজনৈতিক বিরোধীই কেবল নয় বরং সম্ভাব্য হন্তারক হিসেবেও দেখছেন। আর এটি এই দুই বড় দলের মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে ন্যূনতম সহযোগিতার সব পথ বন্ধ হওয়াই পূর্বাভাস দেয়। দুর্ভাগ্যজনক খারাপ আরেকটা নজির তৈরি করা হয়েছে দেশের বৃহৎ বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সরকারের আচরণের মাধ্যমে। জোর করে খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা, স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য তার মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা, স্বাধীনভাবে সমাবেশ করা এবং কোনো কারণ ছাড়াই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করতে না দেয়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সব ধরনের হয়রানির দরজাকেই খুলে দেয়। বিরোধীদলকে নির্যাতন কিংবা হয়রানি বিশ্বের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়।

আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় হচ্ছে ১৯৯১ সালের পর থেকে গণতন্ত্রের পথে আমাদের হাঁটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তবে মাঝখানে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছুটা ছন্দ পতন ঘটায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে, বিশেষত আমাদের দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা। তাদেরকে এতটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি কিংবা অবরুদ্ধ করা হয়নি যতটা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে। সমানভাবে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোনো ধরনের জবাবদিগিতাহীন সরকার গত কয়েকদিন ধরে কোনো কারণ ছাড়াই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে হয়রানি এবং নির্দয় আচরণ করা হচ্ছে, কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই এসব করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, “বিএনপি নেত্রী মুক্ত, চাইলেই বাসায় যেতে পারেন। কিন্তু তিনি শুধু শুধু নাটক করছেন।” খালেদা যা করছেন তা মিথ্যা বলেও অভিযুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমরা এটা নিশ্চিত করে বলতে চাই যে, খালেদা জিয়া উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে পারেন না। ”তিনি বলেন, “খালেদা জিয়াকে খুনের মামলা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।” স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বলেন, “তথ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা আমরা শুনেছি তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি যদি বাসায় যেতে চান তবে সরকার তার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।” স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, “বিএনপি তাদের নেত্রীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব দেয়া শেখ হাসিনার দায়িত্ব। তাকে আমরা নিরাপত্তা দেব।”

এর সবগুলো মন্তব্যই তিরস্কার, এসব বক্তব্য এটা প্রমাণ করে না যে বিএনপি নেত্রী মুক্ত। যাই বলা হোক, যেভাবেই রাখা হোক প্রকৃতপক্ষে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা এক্ষেত্রে হয়তো বলতেই পারেন, শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতার হত্যার জন্য বিএনপি যা করেছে এর তুলনায় এটা কিছুই না। স্পষ্টতই আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর ও বিদ্বেষমূলক হামলার সঙ্গে খালেদা জিয়ার হয়রানির তুলনা চলে না। তবে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, একটা রাষ্ট্র এরকম প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের ছায়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে পারে না। এ পাল্টা প্রতিশোধ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, “চোখের বদলা চোখ- আমাদের রাজনীতিকে অন্ধ করে দেবে।”

আমি দৃশ্যতই দেখতে পাচ্ছি, কিছু আওয়ামী লীগ নেতা উপহাসের সুরে আমাকে প্রশ্ন করছেন- কেন আমি বিএনপি চেয়ারপারসনের অধিকারের পক্ষে এত ওকালতি করছি। তারা বলছেন, “আমার আসল সহানুভূতির জায়গাটা ফাঁস হয়ে গেছে। আমার চেহারা প্রকাশ হয়ে গেছে।” এরকম অনেক কিছু। আমার বিনয়ী জবাব হচ্ছে, আমি দেশের ভবিষ্যতের জন্য এসব বলছি। সেইসব তরুণের জন্য বলছি যাদের সম্ভাবনা ডানা মেলেছে।

আমাদের এগিয়ে যাবার জন্য যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ‘সব কিছুতে জয়ীদের কর্তৃত্ব’ এ রাজনীতি ঠিক নয়। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, মূল উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করতে না পারলে আমরা এটা পাবো না।

একটা প্রশ্ন রেখে কথা শেষ করতে চাচ্ছি, যে নজির আমরা স্থাপন করতে চাচ্ছি তার ফলাফলটা কী হবে? আমরা ইতিমধ্যে অতীতের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখল, বিরামহীন, অপরিকল্পিত ও সুবিধাজনক উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা সংসদে সংবিধান সংশোধনের কারিগরি, ভিন্ন মতের সুযোগ করে না দেয়ার ফলাফল ভোগ করে যাচ্ছি। আর এখন বিরোধীদল ধ্বংস করে দেবার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি।

প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’ নিউটনের এ তৃতীয় সূত্রকে আমরা অবজ্ঞা করতে পারি, তবে এটা নিজের বিপদকে ডেকে এনেই সম্ভব। [ডেইলি স্টার থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: গোলাম ইউসুফ সাগর]



মন্তব্য চালু নেই