এক মাসে ৪৩টি সংঘর্ষ; নিহত ৭, আহত ৫ শতাধিক

ক্ষমতাসীনেরা মরছে নিজেদের দ্বন্দ্বে

ক্ষমতার লড়াই, আধিপত্য বিস্তার, দখলবাণিজ্য আর চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একের পর এক খুন হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক। যাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে তারা এখন অনুসারী ও নিরাপত্তা না নিয়ে রাস্তায় বের হন না। গত এক মাসে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৪৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় সাতজন নিহত ও সাড়ে পাঁচ শতাধিক আহত হয়েছেন।

গত শুক্রবার কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কলাকান্দি বাজারে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন রেজাউল করিম সেন্টু নামে এক ব্যক্তি। কলাকান্দি ইউনিয়নের সভাপতি হাবিব উল্লাহ বাহার ও সাবেক সভাপতি ইব্রাহীম গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। টেঁটাবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সেন্টু। এ ঘটনায় আরো অন্তত ১৫ জন আহত হন। তিতাস থানার ওসি তারেক মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের নান্দাইলে পৌর আওয়ামী লীগের সমাবেশ নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আবুল মনসুর ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়ার বড় ভাই।

গত বৃহস্পতিবার সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহতসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. হিমাদ্রী শেখর রায়ও রয়েছেন। নিহত সুমন দাস সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সিট বরাদ্দকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন।

এভাবেই ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলে আসছে। হতাহত হচ্ছেন দলীয় নেতাকর্মীসহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। গত ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর গুলশানে শত শত লোকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে। এই ঘটনায় সরাসরি জড়িত জাহিদ সিদ্দিকী তারেকসহ দু’জন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। তদন্ত শেষে এই ঘটনায় তারেক ছাড়া আরো ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। চার্জশিটে যারা রয়েছেন তাদের অন্যতম হলোÑ ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, তার ড্রাইভার জাহাঙ্গীর, দেহরক্ষী শহিদুল ইসলাম, পলাশ, দেবাশীষ, হানিফ, জাকির, দেলোয়ার, ফাহিমা ইসলাম লোপা ও আহকাম উল্লাহ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ ঘটনায় আরো কয়েক প্রভাবশালী যুবলীগ নেতার নাম উঠে এলেও চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ পড়ে যায়।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় চলছে খুনের বদলে খুন-গুম। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট খুন হয়েছেন রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। এর আগে গুম হয়েছেন তার শ্বশুর এবং ওই ওয়ার্ডেরই আওয়ামী লীগ সভাপতি নুর হাজী ও তার অপর এক জামাতা। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি আগারগাঁও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন করার কথা ছিল। তাকে হত্যার পরে নুর হাজী পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এরপরই নিখোঁজ হন নুর হাজী ও তার এক জামাতা।

সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের পাশে কুপিয়ে হত্যা করা হয় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার গিয়াস উদ্দিন রাজুকে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম ওরফে আক্তার বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় রাজুর আরো দুই ভাই আহত হন। সেখানে গুলিবর্ষণের ঘটনাও ঘটে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হতাহতরাও যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর মতিঝিলে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের দ্বিতীয়তলায় সন্ত্রাসীরা খায়রুল মোল্লা নামে এক পরিবহন নেতাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। খায়রুল আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। এই ঘটনায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। তারা হলোÑ আবুল কালাম, তৈয়ব আলী, আলী আকবর বাবুল, আলমগীর হোসেন, সালাউদ্দীন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, এ বি এম আওলাদ হোসেন, মুসফিকুল মান্নান বায়ু, বাচ্চু মিয়া, গিয়াস উদ্দীন জাফর, সুমন রেজা, সেলিম সারোয়ার, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মোক্তার হোসেন নিপা, সাইদুজ্জামান শান্ত ও রহমত উল্লাহ সেন্টু। তারা সবাই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সাথে জড়িত।

এ দিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, জমি দখল, ঘাট দখল, টার্মিনাল দখল, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত লেগেই আছে।

গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে নিখোঁজ হন আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজন। পরে তাদের লাশ উদ্ধার হয় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। তাদের মধ্যে পাঁচজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত নূর হোসেনও আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশির ভাগ সময় দেখা যায় পুলিশের সামনেই ক্ষমতাসীনেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই বলছে না। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই স্থানে অ্যাকশনে যাওয়ার চেষ্টা করলেই ঝামেলা। কোন গ্রুপের পক্ষ নিয়ে তারা বিপদে পড়বেন এই আশঙ্কায় তারা কোনো অ্যাকশনে যান না। কখনো কখনো দুই গ্রুপের মধ্যে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন মাত্র।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে চলতি মাসে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অন্তত অর্ধশত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ছয়জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৫০০। গত অক্টোবর মাসে দেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কোন্দলে সংঘর্ষ হয়েছে ৪৩টি। এতে নিহত হয়েছেন সাতজন। আর আহত হয়েছেন ৬৬৩ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র্র : নয়া দিগন্ত



মন্তব্য চালু নেই