ক্যালসিয়াম মুঠো মুঠো খেলে মাসুল হাড়ে হাড়ে, সতর্ক করছেন চিকিৎসকেরা

বমি ভাব, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা আর সারছিলই না বছর ত্রিশের শর্বরী দেবনাথের। ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল। নানা কথার ফাঁকে জানতে চাইলেন, শর্বরী নিয়মিত কোনও ওষুধ খান কি না। শর্বরী জানালেন, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাচ্ছেন গত এক বছর ধরে। ডাক্তার অবাক। তাঁকে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিলেন কে? জানা গেল, নানা বিজ্ঞাপন দেখে তিনি নিজেই ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করতে ট্যাবলেট খাচ্ছেন। স্পষ্ট হল, ব্যথা, বমিভাবের উৎসও সেটাই।

বিচ্ছিন্ন নজির নয়, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্রেফ কিছু ভাসা-ভাসা ধারণার বশে অনেকেই ইদানীং ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়া শুরু করেছেন। ডাক্তারদের মতে, এর পরিণতি খুবই উদ্বেগজনক। অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম শরীরে গেলে হার্টের অসুখের ঝুঁকি বাড়ে। পেট ব্যথা, বমিভাব, অবসাদ এমনকী কিডনিতে পাথরও হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যানসারের ভয় থাকে। শরীরে আয়রন, জিঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়ামের মিশে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত করে দেয় অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম।

তবে, ক্যালসিয়ামের অভাবও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ, রোজকার খাবার থেকে ক্যালসিয়াম না পাওয়া গেলে রক্তে এর অভাব হয়। তখন ক্যালসিয়াম নেওয়া শুরু হয় হাড় থেকে। স্বভাবতই, হাড়ের ক্ষয় হতে শুরু করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ৫০-এর নীচে থাকা মহিলা এবং ৭০-এর নীচে থাকা পুরুষের শরীরে প্রতি দিন ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। ৫০ এবং ৭০-এর উপরে থাকা মহিলা ও পুরুষের জন্য রোজ প্রয়োজন ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। মেনোপজের পরে দরকার ১৫০০ মিলিগ্রাম। অথচ বেশিরভাগ মহিলাই ৬০০ থেকে ৭০০-র বেশি পান না। তবে যা প্রয়োজন, তার সবটাই রোজকার খাবারের মধ্যে দিয়ে শরীরে যাওয়া ভাল। দুধ, শাকসব্জি, ডিম, মাশরুম, ছোট মাছে ক্যালসিয়াম থাকে।

অর্থোপেডিক বিপ্লব দলুই জানান, কিছু কিছু মাপকাঠি দেখে তবেই ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার কথা ভাবা হয়। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা, ডেক্সা স্ক্যান করে হাড়ের ঘনত্ব ইত্যাদি দেখে তবেই ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়া উচিত। তাঁর কথায়, ‘‘ইচ্ছে মতো ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খেলে
হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকিই বেশি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যালসিয়াম জমে সমস্যা হতে পারে। বিশেষত কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।’’

অর্থোপেডিক কুণাল সেনগুপ্তের মতে, ‘ওভার মেডিকেশন’ এ ক্ষেত্রে খুব ক্ষতিকর। শরীরের বিভিন্ন পেশীতে ক্যালসিয়াম জমতে থাকে। তিনি বলেন, ‘‘মেনোপজের পরে মহিলাদের আমরা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খেতে বলি। অস্টিওপোরোসিস বা অস্টিওপেনিয়ার নির্দিষ্ট সঙ্কেত পেলে খেতে বলা হয়। তাঁর কথায়, ‘‘পুরুষেরা সাধারণত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট কম খান। মহিলারাই বরং বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে শুরু করে দেন। হয়তো সবে ত্রিশ ছুঁয়েছে, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজনীয়তাই নেই, তা-ও হরেক বিজ্ঞাপনে মজে তিনি খাওয়া শুরু করলেন। তাতে সমস্যা তো হবেই। হাইপার ক্যালসেমিয়া খুবই খারাপ।’’

সাধারণ ভাবে শরীরের ৯৯ শতাংশ ক্যালসিয়ামই গিয়ে জমা হয় হাড় এবং দাঁতে। রক্তে মিশে থাকা ক্যালসিয়াম স্নায়ুর সঙ্কেত পাঠানো, হরমোনের ক্ষরণ ও মাংসপেশির সঙ্কোচন-প্রসারণে সাহায্য করে। শরীর যদি রোজকার খাবার থেকে ক্যালসিয়াম না পায়, তখন রক্তে ক্যালসিয়ামের অভাব হয়। ওই কাজগুলি করার জন্য হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নেওয়া শুরু হয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হাড় দুর্বল হতে শুরু করে। মহিলাদের, বিশেষ করে মেনোপজ হওয়ার পরে হাড় ভঙ্গুর হওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু বছরের পর বছর সঠিক খাওয়াদাওয়া হল না, হঠাৎ এক দিন ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়া শুরু হল, তাতে কি বিপদ এড়ানো যায়?

দেশ-বিদেশের নানা সমীক্ষা রিপোর্ট দাবি করছে, বিপদ এড়ানোর নিশ্চয়তা খুবই কম। ইউনাইটেড স্টেটস প্রিভেনটিভ সার্ভিসেস টাস্ক ফোর্স ১৩৫টি সমীক্ষা রিপোর্টের তুল্যমূল্য বিচার করে জানিয়েছে, মহিলাদের হাড় ভাঙা ঠেকাতে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের ভূমিকা নগণ্য। এ দেশেও নানা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে একই তথ্য।

অর্থোপেডিক রামেন্দু হোমচৌধুরীর বক্তব্য, ক্যালসিয়ামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে ম্যাগনেশিয়াম। তিনি বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে বয়স্কা মহিলা, অন্তঃসত্ত্বা বা মেনোপজ হওয়া মহিলাদের বুক ধড়ফড় করে। অনেকে ভাবেন সেটা হার্টের সমস্যা। আসলে বেশির ভাগ সময়েই তা হয় ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে। দুধ, বিভিন্ন দানা জাতীয় সব্জি, ছোট মাছ, ডিমে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়াম পাওয়া যায়। কম বয়স থেকে শরীরে এগুলি যেতে শুরু করলে বাইরের সাপ্লিমেন্ট কম ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয়।’’-আনন্দবাজার



মন্তব্য চালু নেই