কোমর ব্যথা প্রধানত কী কারণে হয়?

কোমর ব্যথা প্রচলিত সমস্যা। বিভিন্ন কারণে এই ব্যথা হয়। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. নুরুজ্জামান খাঁন। তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

প্রশ্ন : কোমর ব্যথা প্রধানত কী কী কারণে হয়?

উত্তর : কোমর ব্যথা একটি বড় শব্দ। বড় একটি বিষয়। এমন কোনো মানুষ নেই যার অন্তত একবার হলেও জীবনে কোমর ব্যথা হয়নি। নানাবিধ কারণে কোমর ব্যথা হয়। তার ভেতরে সবচেয়ে প্রচলিত হলো কোমরের যে মাংসগুলো রয়েছে সেগুলোর দুর্বলতার কারণে ব্যথা। আমাদের অবস্থানগত অভ্যাসের কারণে এই কোমর ব্যথা সবচেয়ে বেশি হয়।

দ্বিতীয় যে কারণটির জন্য হয় একে ডিস্কোজেনিক পেইন বলা হয়। মেরুদণ্ডের যে হাড়গুলো রয়েছে সেগুলোকে আমরা ভার্টিব্রা বলি। এগুলোর মাঝে একটি করে ডিস্ক থাকে, এগুলোর সমস্যার জন্য কোমর ব্যথা হয়। এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ।

এরপর কোমরের যে হাড়গুলো আছে সেগুলোর যদি দুর্বল হয়, বয়সজনিত কারণে, অস্টিওপরোসিস হয়, এর জন্য হতে পারে।

এরপর মেরুদণ্ডের হাড়গুলো একটা থেকে আরেকটি যদি সরে যায় সেক্ষেত্রেও এই কোমর ব্যথা হতে পারে। যাকে আমরা স্পোনডাইলোলিসথেসিস বলি।

কোমরে এখানে যদি সংক্রমণ হয়, আমাদের দেশে খুব প্রচলিত যেটি হয়, স্পাইনাল টিবি এ কারণেও কোমর ব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া টিউমার হলেও কোমর ব্যথা হতে পারে। সুতরাং কোমর ব্যথার আসলে অনেক কারণ।

প্রশ্ন : কী কারণে কোমর ব্যথা হচ্ছে সেটি বোঝার উপায় কী?

উত্তর : হ্যাঁ, অবশ্যই এটাই তো একজন চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব। রোগী এলে তার লক্ষণগুলো আমরা শুনব। এরপর তাকে ক্লিনিক্যালই পরীক্ষা করে দেখব। এরপর তার সমস্যাগুলো বুঝব। এর ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান করব। আসলে ব্যথার ধরন দেখে আমরা প্রথমে কিছুটা আন্দাজ করি যে, কী কারণে হচ্ছে।

দেখা যায়, কোমর ব্যথা হলে কোমরের এখানে ব্যথা অনুভূত হয়। ব্যথাটা মেরুদণ্ডের ঠিক পেছনের কেন্দ্রে থাকতে পারে। অথবা একটু পাশে থাকতে পারে। অথবা পুরো অংশে থাকতে পারে। কোমর ব্যথা থেকে সাধারণত যেই বিষয়টি বেশি হয়, ব্যথা পায়ে চলে যায়। পায়ের পেছন দিক দিয়েও ব্যথা যেতে পারে। পাশ দিয়েও যেতে পারে। পায়ের ওপরের অংশেও ব্যথা থাকতে পারে। নিচের অংশেও ব্যথা হতে পারে। আর এই ব্যথার সঙ্গে তার অবশ লাগা ভাব থাকতে পারে। আর ঝি ঝি লাগার সমস্যা থাকতে পারে। আর কোথায় কোন পাশ দিয়ে ব্যথা হচ্ছে সেটি দেখে আমরা নির্ধারণ করতে পারি, কোমরের কোন ডিস্ক বা কোন অংশে সমস্যাটা হচ্ছে। কোন রগ বা স্নায়ু থেকে ব্যথা হচ্ছে সেটা আমরা বুঝতে পারি।

প্রশ্ন : কোমর ব্যথার চিকিৎসা কিসের ওপর নির্ভর করে?

উত্তর : কোমর ব্যথার কারণগুলো প্রথমে আমরা নির্ধারণ করি। নির্ধারণ করার জন্য দুটো পরীক্ষা খুব জরুরি বলে আমরা ধরে নেই। প্রথমে রোগী এলে একটি সাধারণ এক্স-রে করে হাড়ের কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি আমরা বুঝতে পারি। আর স্নায়ুর কোনো সমস্যা আছে কি না, আর ভেতরে যে স্নায়ু সেখানে কোনো সমস্যা আছে কি না, সেটি দেখি বা ওখান থেকে কোনো টিউমার হয়েছে কি না বা চাপ খেয়ে আছে কি না সেটি দেখি। একটি এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা সেটি বুঝতে পারি। আমরা সব পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে যখন দেখি তার সমস্যা কী, তখন আমরা সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করতে যাই।

পেশির দুর্বলতার কারণে যেই কোমর ব্যথা হয় এর জন্য কোনো অস্ত্রোপচার লাগে না। শুধু কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিয়ে এটি আমরা ভালো করতে পারি। এখানে ফিজিওথেরাপির একটি ভূমিকা আছে। আর অন্য যে কোমর ব্যথার কারণ রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির কোনো ভূমিকা নেই। আপনার যদি টিউমার হয় আগে সেটি অস্ত্রোপচার করতে হবে।

আপনার যদি ডিস্কে কোনো সমস্যা থাকে, সেটি যদি বের হয়ে এসে আপনার স্নায়ুকে চাপ দিয়ে রাখে, তাহলে তো অবশ্যই স্নায়ুকে চাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। ওখানে একটি সার্জারি করতে হবে যাতে স্নায়ুর সমস্যাটা দূর হয়ে যায়।

আর মেরুদণ্ডের হাড়গুলো যদি একটি থেকে আরেকটি সরে যায়,   তখন আমরা উপরেরটি এবং নিচেরটিকে  একসাথে আনার জন্য স্ক্রু দিয়ে, রড দিয়ে ঠিক করি। আর টিউমার থাকলে অবশ্যই অস্ত্রোপচার করতে হবে।

আর ডিস্কের যেই সমস্যা এর জন্য আমাদের চিকিৎসার কতগুলো ধাপ রয়েছে। প্রথম হলো কনজারভেটিভ চিকিৎসা, যেটা আমরা ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করি। যদি ডিস্কের বাইরের অংশে কোনো সমস্যা থাকে, শুধু দেখা যায় যে কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিলে ভালো হয়ে যায়, তাহলে সেটি দেই। অনেক সময় কনজারভেটিভ চিকিৎসায় ভালো না হলে আমরা ইনজেকশন দেই।

প্রশ্ন : ডিস্কের সমস্যা হওয়ার কারণ কী? এটি কি বয়সজনিত কারণে হয়, না কি অন্য কোনো আঘাত থেকে হয়?

উত্তর : কোমর ব্যথার ডিস্কের কারণে ব্যথা আমাদের দেশে কেবল নয় পুরো বিশ্বেই এর প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। বেড়ে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের জীবন যাপনের আধুনিকীকরণ। যেমন আমরা দীর্ঘ সময় বসে থাকি। সেডেন্ডারি জীবন যাপন করি। ধূমপান একটি বড় বিষয় এই কোমর ব্যথার জন্য। ডিস্কের বাইরের অংশ নরম হয়ে যায়। বয়সজনিত কারণেও এগুলো চলে আসে।

এটা চলে এলে ভেতর থেকে নিউক্লিয়াস বের হয়ে আসে। বের হয়ে এসে যখন রগকে চাপ দেয় সেখানে একটি প্রদাহ হয়। এই প্রদাহ হওয়ার জন্য যেই রাসায়নিক উপাদানগুলো আসে সেগুলোই প্রধান কারণ ব্যথা তৈরি করার জন্য। দেখা যায় ইনজেকশন দিলে প্রাথমিকভাবে ভালো করতে পারি। আর যে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার লাগে সেই ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।

প্রশ্ন : অস্ত্রোপচার করতে হবে- এই বিষয়টি আপনারা কখন নির্ধারণ করেন?

উত্তর : রোগীর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা দেখে আমরা সীদ্ধান্ত নেই কখন অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্রুত অস্ত্রোপচার লাগে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা কনজারভেটিভ চিকিৎসা দেই। আর যদি দেখা যায় কনজারভেটিভ চিকিৎসা ভালো হচ্ছে না, তখন আমরা সার্জারিতে যাই।

প্রশ্ন : বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি রোগীদের সার্জারির প্রতি একটি অনাগ্রহ থাকে। তারা মনে করেন সার্জারি করে আরো ক্ষতি হবে। খুব লাভ কিছু হবে না। সেক্ষেত্রে তাদের আশ্বস্ত করেন কীভাবে?

উত্তর : একটি বিষয় হলো যেটি অস্ত্রোপচার দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে সেটি কিন্তু অস্ত্রোপচার করেই চিকিৎসা করতে হবে।

প্রশ্ন : তাদের ক্ষেত্রে হয়তো দেখা গেল ফিজিওথেরাপির ভূমিকা নেই। এর পরও ফিজিওথেরাপি করতে যাচ্ছেন। এতে হয়তো সাময়িক আরাম পাচ্ছেন। তবে আবারও ব্যথা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কী বলবেন?

উত্তর : আপনি একটি ভালো পয়েন্ট ধরেছেন। ফিজিওথেরাপির অবশ্যই ভূমিকা রয়েছে, তবে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে কে রোগী পাঠাবে? কী কারণে ব্যথাটি হচ্ছে এটি তো আগে নির্ধারণ করতে হবে। এটি কে করবে? এটি তো একজন চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন। এই বিষয়ের যে বিশেষজ্ঞ সে নির্ধারণ করবেন। এই বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ের চিকিৎসকরা কিন্তু বিষয়টি অত ভালো জানবেন না। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাববেই ফিজিওথেরাপিস্টের বিষয়টি নির্ধারণ করার কথা না। সুতরাং এই বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ যখন নির্ধারণ করবেন এই ব্যথাটি কেবল পেশির ব্যথার জন্য, তখনই ফিজিওথেরাপির একটি ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি নিজেই ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে রোগী পাঠাই।

প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কীভাবে আপনারা রোগীদের বোঝান?

উত্তর : অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা অস্ত্রোপচার করতে চায় না। যখন বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে, অনেক সময় দেশের বাইরেও চলে যায়, বাইরে থেকে যখন দেখে তারাও অস্ত্রোপচারের কথা বলছে, তখন বোঝে। আমি অনেক রোগী পাই যারা বাইরে থেকে ঘুরে এসে আবার আমার কাছেই অস্ত্রোপচার করে। অস্ত্রোপচার যেখানে দরকার সেখানে সেটি ছাড়া বিকল্প নেই।

প্রশ্ন : কোমর ব্যথা প্রতিরোধের উপায় কী?

উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটি কথা বলতে চাই, অস্ত্রোপচারের অনেক ধরন আছে। আগে অনেকখানি কেটে অস্ত্রোপচার করতাম। এখন খুব ছোট্ট করে করা হয়। যেটাকে মিনিমাল স্পেসিভ স্পাইন সার্জারি বলা হয়। এর থেকে আরো আধুনিক পদ্ধতি এসেছে এটি হলো অ্যান্ডোস্কোপিক স্পাইন সার্জারি। আমরা এখন অ্যান্ডোস্কোপি করে, মনিটরে দেখে ছোট্ট একটি ফুটো করে ডিস্কগুলো নিয়ে আসতে পারছি। লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে অজ্ঞানও করা লাগছে না। এত ছোট করে এটি কাটা হয় যে সেলাই দেওয়া লাগে না। এর মানে দেখা যাচ্ছে লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে রোগীকে কোনো বড় ধরনের কাটা-ছেড়া না করে, আমরা এই অস্ত্রোপচার সফলভাবে করে আসতে পারছি। সুতরাং অস্ত্রোপচারে ভয় পাওয়ার কোনো বিষয় নেই।

আর জীবন যাপন পরিবর্তন করার যে বিষয়টি রয়েছে। আমরা যে দীর্ঘ সময় বসে থাকি, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকি, ওজন তোলার কাজগুলো করি তাহলে দেখা যাচ্ছে পেশির কারণে কোমর ব্যথাটা বেশি হচ্ছে। সুতরাং আমাদের উচিত দীর্ঘ সময় বসে না থেকে কিছু সময় হাঁটলাম, আবার লম্বা সময় বসে না থেকে কিছু সময় দাঁড়িয়ে কাজ করলাম, কিছু সময় বসে থাকলাম। আর বসারও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কোমরকে সোজা করে বসে থাকতে হবে। আর যারা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করবে তারা কোমরের পেছনে ছোট একটি কুশন দিয়ে বসতে পারে। তাহলে তার কোমর ব্যথাটা কম হবে। একই অবস্থায় বেশি সময় ধরে থাকা যাবে না।এনটিভি



মন্তব্য চালু নেই