কোটিপতি ঝাঁড়ুদার

শাহিদুল ইসলাম : অ্যাপেলের প্রাক্তন নির্বাহী স্টিভ জবস প্রায় বলতেন ‘অতীতকে মুছে ফেল কিন্তু ভুলে যেও না। অতীত তোমার জীবনের ভিত্তি। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

দিবালোকের মতো সত্য এ কথা আমরা হয়তো সবাই জানি। কিন্তু মানি কয়জন? আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা সফলতা লাভের পর তাদের অতীতকে ভুলে যান। অতীতকে গোপন করার এক আপ্রাণ চেষ্টা তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। অথচ সমাজে যারা সফল, মানুষ যাদের নাম যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, তাদের বেশির ভাগ অতীতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। কারণ তারা জানেন এটাই মহত্ব্য, এটাই মনুষত্ব্য।

প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের এমন একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, যিনি শূন্য থেকে শুরু করে লাখো ডলারের মালিক হয়েছেন। কিন্তু ভুলে যাননি তার অতীতকে। বরং তিনি তার অতীতকে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেন।

চীনের হংসান জেলার ইউহান শহরের বাসিন্দা ইউ ইউজহেন। ৫৩ বছর বয়সি এই নারী ইউহান শহরে ২১টি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ডলার। তারপরও তিনি গত ১৫ বছর ধরে দেশটির স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে রাস্তা ঝাঁড়ু দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। তার এক হাতে ঝাঁড়ু, অন্য হাতে ১৫ লাখ ডলার!

সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে মাসে ২১৮ ডলার আয় করেন ইউজহেন। কি আশ্চার্য! ১৫ লাখ ডলার স্থাবর সম্পত্তির মালিক রাস্তা ঝাঁড়ু দেওয়ার কাজ করেন? এই রহস্যের সমাধান পেতে ইউ ইউজহেনের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে আমাদের।

১৯৮০ সালে ইউজহেন ও তার বেকার স্বামী সবজি চাষি হিসেবে তাদের কর্মজীবন শুরু করেন। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে পাঁচ বছর পর তারা ছোট তিনটি ঘর নির্মাণ করেন। ওই সময়ে ইউহান শহরে কাজের জন্য বাইরে থেকে অনেক লোক আসত। এ সুযোগে ইউজহেন তাদের ঘরগুলো মাসে ৫০ ইউয়ানে ভাড়া দিতেন। সবজি বিক্রি ও বাড়ি ভাড়া থেকে পাওয়া অর্থ জমিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে তারা একটি পাঁচ তলা ভবন নির্মাণে সক্ষম হন।

এরপর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যে ইউজহেন আরো কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক হন। তবে তিনি কাজ থেকে বিন্দুমাত্র দূরে সরে যাননি। ১৯৯৮ সালে যখন তিনি ১০টি ফ্ল্যাটের মালিক তখন স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের সামান্য বেতনে রাস্তা ঝাঁড়ু দেওয়ার চাকরি নেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলছে।

ইউজহেনের জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৮ সালে। ওই বছর চীন সরকার শিল্পকারখানা নির্মাণের জন্য ইউহান শহরে জমি অধিগ্রহণ শুরু করে। জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার শহরের বাসিন্দাদের নগদ অর্থ অথবা অন্য জায়গায় অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ পান ইউজহেন। আর তা দিয়ে ২১টি অ্যাপার্টমেন্ট করেন।

২১টি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ইউজহেন যে ভাড়া পান তা দিয়ে তিনি ও তার পরিবার দিব্যি আরাম-আয়েশে কাটাতে পারেন। তবে কেন তিনি এখনো কাজ করেন? সাউথ চায়না মর্নিং-কে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমি জন্মায়নি। জীবনে চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছি। অতীতকে ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি আমি কী ছিলাম!’

তিনি আরো বলেন, আমার সন্তানদের কাছে নিজেকে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। তাদেরকে বলে দিয়েছি তোমরা যদি কাজ না কর, তবে আমি অ্যাপার্টমেন্টগুলো শহর কর্তৃপক্ষকে দান করে দেব। ইউজহেনের ছেলে-মেয়েরা যেন তারই মতো। তার দুই ছেলেমেয়ের দুজনেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো কাজে নিজেদের জড়িয়ে রাখে।

কোনো কাজকে কখনো ছোট করে দেখা উচিত নয়। সব কাজকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। কথাগুলো ছোটবেলা থেকে আমরা মুখস্ত করি। কিন্ত মেনে চলি কয়জন? অথচ কি আশ্চর্য! ইউজহেন তার জীবনকে ঠিক বইয়ের লাইনগুলো মেনেই যেন পার করছেন! আমরা কতজন পেরেছি তার মতো হতে? একজন নারী হয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই অনন্য, অসাধারণ। ‘জয়িতা’ বলে যে খেতাব নারীকে দেওয়া হয় তা ইউজহেনের মতো নারীদেরই প্রাপ্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



মন্তব্য চালু নেই