কে চলাচ্ছেন বিএনপি?

সরকারি দলের হুঙ্কার আর প্রশাসনের কড়াকড়ির মধ্য দিয়েই চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলের টানা অবরোধ।সঙ্গে কয়েকশ ঘণ্টার হরতালও পালিত হয়েছে। সামনে আরো বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এসব কর্মসূচিকে ঘিরে হয়েছে ব্যাপক সহিংসতা। পেট্রল বোমায় দগ্ধ হয়ে প্রান গেছে অর্ধশতাধিক মানুষের।যাদের অধিকাংশই নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। অন্যদিকে ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছেন বিএনপি ও জোটের তরুণ অনেক স্থানীয় নেতা।

এমন যখন অবস্থা তখন বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের কাছ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। ইন্টারনেট, ডিশ লাইন নাই তার কার্যাচলয়ে। অন্যদিকে আইনী জটিলতায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেয়া বক্তব্যও প্রচার বন্ধ। অন্যদিকে দলের অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেফতার এড়াতে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বন্ধ রাখছেন। অনেকে নিজ বাসা ছেড়ে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও প্রশ্ন দল এখন কার নির্দেশে চলছে। যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন খালেদা জিয়ার নির্দেশেই দল চলছে। তিনি যতদিন থাকবেন তার নির্দেশেই সবকিছু হবে। তবে বিএনপি জোটের অনেক শীর্ষ নেতা বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে আছেন বলে জানা গেছে।

জোটের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানানা, নানা কারণে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন তিনি চাইলেও আগের মতো যোগাযোগ করতে পারছেন না।এ অবস্থায় বিএনপির গুলশান অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের খোঁজ খবর দিচ্ছেন। কখনও নির্দেশনাও দিচ্ছেন।

যদিও গুলশান অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, “নেত্রীর নির্দেশনা ছাড়া আমরা কিছু করছি না। যা বলা হয় তাই আমরা পালন করি।”

জোটের একটি সূত্র জানায়, কয়েকদিন আগে জোটের একজন শীর্ষ নেতাকে গুলশান অফিসের একজন কর্মকর্তা টেলিফোন করে আসতে বলেন। ওই নেতা অফিসের সামনে আসার পর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে বেশ কিছু সময় ঘেরাও করে রাখে। পরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত না করেই তিনি চলে যান।

গত একমাস ধরে অবরোধের সঙ্গে হরতাল চললেও গুঞ্জন আছে সামনে অসহযোগের কর্মসূচিও আসবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সারাদেশে অসংখ্য নেতাকর্মী নাশকতার মামলার কারাগারে। যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে ঘর ছাড়া। আছে মৃত্যুর ভয়ও। এমন অবস্থায় মাঠ পর্যাায়ের নেতাকর্মীদের প্রশ্ন কতদিন চলবে এই আন্দোলন? শুধু আন্দোলন করেই কি সরকারকে হটানো যাবে? যদি সরকার দাবি না মানে তাহলে কী পরিণতি হবে?।

যদিও দলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়া পর্য ন্ত আন্দোলন চলবে। সবশেষ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেছেন, “একটি যৌক্তিক পর্যািয়ে না পৌঁছানো পর্য,ন্ত আন্দোলন চলবে।”

বুধবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় এক নেতার সঙ্গে আলাপকালে তিনি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছাড়া এভাবে কতদিন চলবে?। কারা ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) কি পরামর্শ দেন আল্লাহ জানে। শিগগিরই একটা সমাধানে না আসতে পারলে বেঁচে থাকাই তো দায় হয়ে যাবে।”

এদিকে বিএনপিকে নানাভাবে চাপে রাখার পরও কর্মসূচি থেকে সরে না আসা। হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে নাশকতা বন্ধ করতে না পারায় সরকারি দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ব্যাপক চিন্তায় ফেলেছে বলে জানা গেছে। যে কারণে বিএনপি শীর্ষ নেতাদের রিমান্ডে আন্দোলনের নির্দেশনা কে দিচ্ছে, কারা অর্থ দিচ্ছে, কাদের ইন্ধনে সহিংসতা হচ্ছে এসব বিষয় জানার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।

যদিও বিএনপি বলছে তারা নাশকতার রাজনীতি করে না। আন্দোলনের সময় যে সহিংসতা হচ্ছে তার সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নেই। সরকারি দল ও তাদের বিভিন্ন এজেন্টরা এসব কাজ করে বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আটক বিএনপি নেতাদের কাছে কারা পেট্রলবোমা মারছে, কারা অর্থ দিচ্ছে এবং কার নির্দেশে বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে-ঘুরে ফিরে এই তিনটি প্রশ্নই জানতে চাওয়া হচ্ছে।

বিশেষ করে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছ থেকে এসব বিষয় একটু বেশি করে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আলী ফালুর কাছ থেকেও এসব বিষয় জানতে চাওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

তবে আন্দোলনের নির্দেশনার ব্যাপারে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে চলমান আন্দোলনের সব কিছুই দেখভাল করছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

টেলিফোনে তারা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলন কর্মসূচি শুরুর আগে খালেদা জিয়া জেলা পর্যানয়ের অনেক নেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তখনই নেতাদের আন্দোলনের কৌশল বাতলে দিয়েছেন। অনেককে ঢাকায় ডেকে মতবিনিময়ের ভেতর দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলন শুরুর পর এই কাজটি তারেক রহমান করছেন। কখনো নিজেই জেলার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আবার কখনো আস্থাভাজনদের মাধ্যমে নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে যায়।

অন্যদিকে খালেদা জিয়া নিজের ছক অনুযায়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি দিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। আগের আন্দোলনে কয়েকজন উপদেষ্টা ও বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ শুনলেও এবার তিনি (খালেদা) অনেকটা একক সিদ্ধান্তে এগোচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

আবার কখনো খালেদা জিয়ার নির্দেশনাও দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার মাধ্যমে তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে কয়েকজন এ কাজ করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির একাধিক জেলা পর্যায়ের নেতারা জানান, আন্দোলনের কৌশল আগেই ঠিক করা হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন ও সিনিয়র নেতারা এখন নির্দেশনা না দিতে পারলেও আগের নির্দেশনা অনুযায়ী আন্দোলন চলবে।” একই সঙ্গে তারা বলছেন, আন্দোলন এখন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। তাই এ অবস্থায় সিদ্ধান্তে ভুল করলে দল অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন দুলাল  বলেন, “আমরা এখন নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকি না, নির্দেশনা যা দেয়ার কেন্দ্র থেকে তা আগেই দিয়েছে। আন্দোলন শেষ হবে শুধু ম্যাডামের নির্দেশেই।”

দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, “জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবারও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ম্যাডামের (খালেদা জিয়া)নির্দেশে মাঠে থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নেই।এভাবে আন্দোলন কতদিন চলবে তা নিয়ে চিন্তায় আছি।”

বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবুর রহমান সরোয়ার  বলেন, “২০ দলীয় জোটে যে দলগুলো আছে তা নির্বাচনী দল। আমরা দেশের প্রয়োজনেই আন্দোলনে নেমেছি। আমাদের এ আন্দোলনে জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশনায় আমরা মাঠে আছি।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে: জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমান  বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় আন্দোলন চলছে, নেতাকর্মীরা মাঠে আছে। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।”



মন্তব্য চালু নেই