কৃষ্ণকলির গৃহকর্মীর মৃত্যু: পাওয়া যাচ্ছে না বাদিকে

ঘটনার মাত্র এক মাস আগে আগারগাঁও তালতলা মোল্লাবাড়ী ৪১ নম্বরে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলির (নং-৮/এ/বি) বাসায় গৃহশ্রমিক হিসেবে যোগ দেন জান্নাত আক্তার শিল্পী। এর আগেও একই এলাকায় অন্যান্য বাসায় কাজ করেছেন তিনি। সেসব বাসা থেকে কোনো দিন কোনো অভিযোগ আসেনি। স্থানীয় অন্যান্য বাড়িওয়ালাও শিল্পীর মৃত্যুর ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। প্রথমে আত্মহত্যার একটি ইউডি মামলা এবং পরে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেয়ার মামলা চলতে থাকে।

পুলিশ সন্দেহভাজন কন্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলির স্বামী খালিকুর রহমানের আচরণ ও কথাবার্তা সন্দেহজকন মনে করে আটক করে। এর পর থেকে আমার কাছে মীমাংসার জন্য চাপ আসতে থাকে। ৫০ হাজার টাকা দিতে চায়। বলে- কোনো কথা বলা যাবে না এবং মেয়ে বিচার চাওয়া যাবে না। নিহত গৃহশ্রমিক জান্নাত আক্তার শিল্পীর (১৫) মা হালেমা আক্তার মেয়ের মৃত্যুর পরপরই এভাবেই তুলে ধরেছিলেন তার অবস্থান। কিন্তু ঘটনার দুই মাস পর শিল্পীর মাসহ পরিবারের কাউকেই আর আগারগাঁও এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি পরিবারের কাউকে মোবাইল ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলতেও পারছে না তারা এখন কোথায়? তবে আব্দুর রহমান নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, আসামিপক্ষ থেকে কিছু অর্থকড়ি দিয়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আবার এও বলেছেন, পুলিশ দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করেছে।

কে এই জান্নাত আক্তার শিল্পী? : নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার কালদুয়ার গ্রামের শ্রমিক হামিদ ও হালেমা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে শিল্পী তৃতীয়। কৃষ্ণকলির বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করার আগে মিরপুরের এক বাসায় ছিলেন তিনি। ঘটনার মাত্র এক মাস আগে রাশেদা নামের এক মহিলা ওই গৃহকর্মীকে তাদের বাসায় কাজ করার জন্য এনে দেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন গৃহকর্তা খালেকুর রহমান।

ঘটনা : গত ২৩ মার্চ কৃষ্ণকলির আগারগাঁওয়ে বাসায় সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পীকে পাওয়া যায়। কৃষ্ণকলির স্বামী খালেকুর রহমান অর্ক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে অর্কর মুখে আঁচড়ের দাগ দেখে পুলিশ তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে। পরে ঢাকা মহানগর হাকিম আদলতে খালিকুর রহমানকে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে হাকিম মোহাম্মদ নুরু মিয়া দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ঘটনার পরপর গৃহকর্তার বরাত দিয়ে এসআই জুলহাস বলেছিলেন, তিনি (খালেকুর রহমান) বলেছেন বাসায় তার স্ত্রী কাজ নিয়ে গৃহকর্মীর ওপর কিছুটা রাগ দেখিয়েছিলেন। পরে সে অভিমান করে ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘খালেকুর রহমানের মুখে বেশ কয়েকটি আঁচড়ের দাগ দেখা যায়। যা দেখে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা গৃর্হকর্মীর সাথে তার ধস্তাধস্তি হয়েছে। এর এক পর্যায়ে হয়তো সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।

কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলির গৃহকর্মী জান্নাতুল আক্তার শিল্পীর পরিবারের সঙ্গে আপোষ চুক্তির পর গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এতে আত্মহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলেও ধর্ষণ বা অন্য কোনোভাবে হত্যার প্রমাণ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য : শিল্পীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুশীল চন্দ্র বর্মন বলেন, শিল্পী আক্তারের ফরেনসিক প্রতিবেদনে আত্মহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ধর্ষণ বা অন্য কিছুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

থানা সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) সকালে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশের উপস্থিতিতে কৃষ্ণকলির এক বোন, তার স্বামী ও আরও দুয়েকজনের সঙ্গে পুলিশের বৈঠক হয়। সেখানে তাদের সঙ্গে আপোষও হয়। যদিও ওই সময় বৈঠকের তথ্যটি শেরেবাংলা নগর থানার ওসি গোপাল গণেশ বিশ্বাস ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুশীল চন্দ্র বর্মন স্বীকার করেননি।

তবে লিখিত আপোষনামা হয়েছে জানিয়ে নিহত শিল্পী আক্তারের বোন রেনু ঘটনার পরের দিন বলেছিলেন, ‘ওই কাগজে লিখেছি, আমার বোন মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না, একা একা বসে থাকতো।’ এখন রেনুকেও পাওয়া যাচ্ছে না।

ওই সময় (ঘটনার পরের দিন) তিনি বলেছেন, ‘শিল্পীকে মেরে ফেলার খবর জানলেও মামলা করব না। মামলা করলে তো বোনকে আর ফিরে পাব না।’

এর আগে বুধবার (২৩ মার্চ) ঘটনার দিন বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস ও ডা. সোহেল শিল্পী আক্তারের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন শেরেবাংলা নগর থানা পুরিশের কাছে হস্তান্তর করেন।

সুশীল চন্দ্র বর্মন আরো বলেন, ‘শিল্পী আক্তারের মা হালেমা খাতুনের অভিযোগে একটি ইউডি মামলা করা হয় (নং-১২)। সুরতহাল রিপোর্ট করে ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রতিবেদন পাওয়া পর ফৌজদারি আইনের ১৭৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কে প্রতিবেদনকৃত মামলার ঘটনা প্রাথমিক অভিযোগ জানানো হয়েছে।

এর পর থেকে অর্থাৎ ঘটনার আড়াই মাস পরে গৃহশ্রমিক শিল্পী আক্তারের পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ফরেনসিক বিভাগের বক্তব্য : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রভষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ময়না তদন্তে আমরা যা পেয়েছি, সেটাই দিয়েছি। এ বাইরে আমাদের বলার নেই।’

খালিকুর রহমানের বক্তব্য : মামলার আসামি কৃষ্ণকলির স্বামী খালিকুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই পুলিশ আমাকে সন্দেহজনক মনে করে আকট করে। কিন্তু দোষী প্রমাণ করতে পারেনি। তাই পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি যদি দোষী না হই তাহলে শুধু শুধু পুলিশ কেন আমাকে আটক রাখবে। তাছাড়া শিল্পী আক্তারের পরিবারের কেউ এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেনি।’

প্রয়াত শিল্পী আক্তারের পরিবারের স্বজনরা কোথায় থাকেন জানতে চাইলে খালিকুর রহমান এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানান।



মন্তব্য চালু নেই