কৃতজ্ঞ জাতির বিনম্র শ্রদ্ধা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-যিনি দেখিয়েছিলেন মুক্তির পথ, জ্বালিয়ে ছিলেন আশার আলো। যার তর্জনীর ইশারায় শত্রুর বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। সেই তিনিই নিজের বাসভবনে হারিয়েছিলেণ প্রাণ। শনিবার ছিল সেই অশ্রুসিক্ত কলঙ্কময় দিন। বিনম্র শ্রদ্ধায় নত মস্তকে কৃতজ্ঞ জাতি স্মরণ করলো তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। সেই সঙ্গে বিদেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে ফাঁসির রায় কার্যকর করারও দাবি জানানো হয়।
রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বনানী কবরস্থানে পনের আগস্টে অন্যান্য শহীদদের কবর এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শনিবার দিনভর শ্রদ্ধা জানান সমাজের সর্বস্তরের জনতা। কালো বসনে আর বেদনাসিক্ত নীল হৃদয়ে তারা স্মরণ করেন এ দেশের অভ্যুদয়ের মহানায়ক ও তার পরিবারের ৪০তম শাহাদাৎবার্ষিকী। একই সঙ্গে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে জাতীয় শোক দিবস।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি। সাদা রঙের তিন তলা এ বাড়িটি যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিঠস্থান। এ বাড়ির সম্মুখভাগে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। যাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ সেখানে পুষ্পার্ঘ্য দিতে সকাল থেকে নামে শোকার্ত মানুষের ঢল।
সকাল ৬টা ৩৩ মিনিটে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে বাজানো হয়ে করুণ সুর। এরপর পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদনে করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এরপরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা আরেকবার বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- দলের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াস সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ।
এরপর ১৪ দলের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও অন্যান্য শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। এরপর একে একে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
অন্যদিকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। তিনি সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। তিন তলার যে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেখানে শেখ হাসিনা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে দেন।
সকাল ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সর্বস্তরের জনতার জন্য। এরপর থেকে রাজধানীর সব পথ যেন মিশে যায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির দিকে। কে আসেনি সেখানে? যুদ্ধাহত পৌঢ় মুক্তিযোদ্ধা, ঘরের মাঝে আবদ্ধ থাকা গৃহবধূ কিংবা বাবার কোলে চড়ে ছোট্ট শিশু- সবাই এসেছে জাতির পিতাকে নিজেদের ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করতে।
সকাল ৬টার মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু ভবন, রাসেল স্কয়ারসহ আশপাশের এলাকা। হাতে কালো ব্যানার ও বুকে কালোব্যাজ ধারণ করে নারী-পুরুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিশু কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষ এসেছে ৩২ নম্বরে। সবাই পরম শ্রদ্ধায় প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে জাতির জনককে স্মরণ করেছেন। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন।
বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে ছোট বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বনানী কবরস্থানে যান শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি ১৫ আগস্টের শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনায় মোনাজাতে অংশ নেন এবং প্রতিটি কবরে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে দেন। সেখান থেকে তিনি চলে যান টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । শনিবার সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদৎ বার্ষিকী ও শোক দিবস উপলক্ষে তার সমাধিসৌধের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্ড অব অর্নার প্রদান করা হয়। বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। সাদাকালো কারুকাজ করা শাড়ি পরিহিত প্রধানমন্ত্রীকে শোকার্ত দেখাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে সৃষ্টি হয় শোকাবহ পরিবেশ।
পরে প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ ১৫ আগস্টের শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া করেন।
রাষ্ট্রীয় এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অশ্রু সজল হয়ে পড়েন। দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে শোকাশ্রু। এরপর দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শোক দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শোক দিবসের রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি শেষে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের বেদীতে ফুল দিয়ে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বেলা ১১টায় সমাধিসৌধ কমেপ্লেক্সে জেলা প্রশাসন আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা শরীক হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধু ভবনে বসে মিলাদ মাহফিলের মোনাজাতে অংশ নেন। দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ঢাকার উদ্দেশে টুঙ্গিপাড়া ত্যাগ করেন।
সারাদেশেই যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে শোকার্ত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাৎবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন করেছে। জাতির শোকাবহ এ দিনটির স্মরণে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে। জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তান ও তার পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দেশের সর্বস্তরের মানুষ বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে কাঙ্গালী ভোজ, দোয়া, মিলাদ মাহফিল, পূজা ও প্রার্থনার মাধ্যমে দিবসটি পালন করছেন।
মন্তব্য চালু নেই