কুসিক নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত টানাপোড়েন

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে বড় রকমের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সমন্বয়হীনতার চিত্র স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে জোটটির শীর্ষনেতাদের বক্তব্যে। নির্বাচনের আর কয়েকদিন বাকি থাকলেও বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের মহাসচিব এখনও সফর করেননি। কুমিল্লা অঞ্চলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিনিয়র নেতারাও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না।

এছাড়া জোটের অন্যতম বড় শরীক জামায়াতে ইসলামী জোটের মেয়রপ্রার্থীকে সরাসরি সমর্থন না দিয়ে বিরোধিতা করছে। একই ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থীর পাশাপাশি জামায়াতের প্রার্থীও দিয়েছে।

২০ দলীয় জোটের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এই সমন্বয়হীনতার প্রভাব কুসিক নির্বাচনের ফলাফলেও পড়তে পারে।

২০ দলীয় জোট সূত্রে জানা যায়, কুসিক নির্বাচনের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে যেখানে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)র মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজেও জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে জানা গেছে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, গত কয়েকদিন ধরে কুসিক নির্বাচনের প্রচারণায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে জামায়াতের কোনো নেতাকর্মী অংশ নেননি। বরং কুমিল্লায় জামায়াতের সমস্ত নেতাকর্মীরা তাদের সমর্থিত ৫টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত।

এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কুসিক নির্বাচনে জামায়াত ২টি ওয়ার্ডে তাদের একক প্রার্থী মনোনয়ন দিতে চেয়েছিল এবং সেখান থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য বিএনপির কাছে আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু তা না হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব বেড়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এবং কুমিল্লায় জামায়াতের শীর্ষ নেতারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। জামায়াতের প্রত্যাশিত ওয়ার্ড দুটি হচ্ছে ১ নং ৬। এছাড়া বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর সঙ্গেও স্থানীয় জামায়াতের বড় দূরত্ব রয়েছে। এই পরিপেক্ষিতে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটকে চাপে রাখার জন্য মেয়রের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করে যাচ্ছে জামায়াত।

অন্যদিকে, বেগম জিয়া ও বিএনপির মহাসচিবের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করা নিয়ে দলের নেতারাও দ্বিধাবিভক্ত।

একটি অংশ মনে করে, এই নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করবে, সে ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার প্রচারণায় যাওয়া না-যাওয়া প্রভাব ফেলবে না। আবার বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার পরও কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হলে তা বেগম জিয়ার জন্য অসম্মানের বিষয় হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দলের একটা অংশ কুসিক নির্বাচনের প্রচারণায় বেগম জিয়ার অংশ নেওয়া ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেই সঙ্গে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে যে শোডাউনের প্রয়োজন তাতে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা এলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিএনপির একটি অংশের। তাই কুসিক নির্বাচনের প্রচারণায় খালেদা জিয়ার অংশ না নেওয়ার পক্ষে ওই অংশটি।

এছাড়াও জানা যায়, কুসিক নির্বাচন নিয়ে রেদোয়ান আহমদের আমন্ত্রণে বেশ কয়েকটি সমন্বয় সভার আয়োজন করা হলেও জামায়াতে ইসলামেরর কোনো নেতাকর্মী তাতে অংশ নেননি। এমনকি বার বার টেলিফোন করার পরও জামায়াতের পক্ষে থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, বৃহত্তর কুমিল্লার নেতা হিসেবে স্থায়ী কমিটির ৩ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার এবং রফিকুল ইসলাম মিয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই তিন নেতার বিরুদ্ধে কুসিক নির্বাচনে কোনোরকমের ভূমিকা না রাখার অভিযোগ উঠেছে। তারা তাদের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কোনো প্রকার প্রচার-প্রচারণায়ও অংশ নিচ্ছেন না। যদিও এই তিন নেতার নিজ নিজ আসনের প্রচুর ভোটার কুসিক নির্বাচনেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এ ছাড়া কুসিক নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও কুমিল্লা অঞ্চলের নেতা নন। তার বাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহের জামালপুরে।

এ অবস্থায় কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের সভাপতি তাজউদ্দিন মোহাম্মাদের সঙ্গে ঢাকা থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে সহযগিতা করতে চাই। কিন্তু বিএনপি আমাদের সহযোগিতা নিচ্ছে না। আমরা দাবি করেছিলেম, ১ নম্বর এবং ৬ নং ওয়ার্ডে বিএনপি তাদের সমর্থিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিক, কিন্তু বিএনপি আমাদের কথা শোনেনি।’
ওই নেতার দাবি, গত শুক্রবার মেয়রের ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে তার দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

তাজউদ্দিন মোহাম্মাদের উল্টো অভিযোগ, বিএনপির মেয়র প্রার্থীকে তারা অসহযোগিতা করছেন না বরং বিএনপি তাদের দূরে রাখছে।

বিএনপির কুমিল্লা অঞ্চলের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং কুমিল্লা অঞ্চল থেকে আসা জাতীয় নেতারা কেন নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি যোগ দিচ্ছেন না, বেগম জিয়া এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল যাচ্ছেন কিনা এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমিও ওখানে যাইনি, কৌশলগত কারণেই যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না।

তিনি বলেন, ‘সাক্কু নতুন না, সেখান থেকে খোঁজখবর পাচ্ছি। স্থানীয়রা যে কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে, জনগণ সুষ্ঠুভাবে যদি ভোট দিতে পারে, তাহলে মনে করি আমাদের সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে জয় লাভ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কুমিল্লায় জামায়াতের বিষয়টি বা সেখানে সমন্বয়কের বিষয়টি নজরুল ইসলাম খানই দেখছেন।’

মোবাইল ফোনে কুমিল্লায় অবস্থান করা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখন আর সে রকম নয়। তারা (জামায়াত) এখন সহযোগিতা করছে। এখন পর্যন্ত মোটামুটি সহযোগিতা করছে বলে আমরা বলতে পারি।’-পরিবর্তন



মন্তব্য চালু নেই