কামারুজ্জামানের উত্থান-পতন

কামারুজ্জামান আলোচিত, সমালোচিত, নিন্দিত একটি নাম। ইতিহাসের পরিক্রমায় ৪২ বছর পর একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃতদণ্ড কার্যকর হওয়া তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি। কামারুজ্জামানের জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠা, একাত্তরের ভূমিকাসহ তার জীবনের অজানা নানাদিক রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-

কামারুজ্জামানের বেড়ে ওঠা : ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর জেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের মুদিপাড়া গ্রামে কামারুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইনসান আলী সরকার।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান কুমরী কালিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার পর শেরপুর জিকেএম ইন্সটিটিউশনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে জিকেএম ইন্সটিটিউশন থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭-৬৯ সেশনে জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ হতে এমএ পাস করেন।

ছাত্রসংঘে কামারুজ্জামান : কামারুজ্জামান ১৯৬৭ সালে শেরপুর জিকেএম ইনস্টিটিউশনের ১০ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সমর্থক হিসেবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন।

আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজে পড়ার সময় কলেজের হল শাখার ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহকারী সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৭০ সালের শেষের দিকে কেন্দ্রের নির্দেশে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন ইসলামী ছাত্রসংঘের নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যখন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন, তখন তিনি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক অফিসের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করেন।

ছাত্র শিবির প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি এবং পরে সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৭৮ সালের ১৯ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং একমাস পরই নির্বাচনের মাধ্যমে সেশনের বাকি সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮-৭৯ সালেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন।

একাত্তরের ভূমিকা : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন।

একাত্তরের ২২ এপ্রিল জামালপুর মহকুমায় আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা একান্ত অনুগত নেতাকর্মীদের তার নেতৃত্বে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে উঠে।

১৬ মে পরীক্ষামূলকভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর, ময়মনসিংহ সদর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইল জেলার ৪৭ জন ছাত্রসংঘের কর্মীকে আলবদর বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে সশস্ত্র সামরিক ট্রেনিং দেন তিনি।

কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ সদরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা ইত্যাদি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে।

কর্মজীবন : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮০ সালে বাংলা মাসিক ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮১ সালে তাকে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দশ বছর দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।

পরে ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত গণজাগরণ মঞ্চের দাবির প্রেক্ষিতে কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার প্রেসক্লাবের সদস্য পদ বাতিল করা হয়।

পরিবার : কামারুজ্জামানের স্ত্রীর নাম নূরুন্নাহার। কামারুজ্জামানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলেরা হলেন- হাসান ইকবাল, হাসান ইকরাম, হাসান জামান, হাসান ইমাম এবং আহমেদ হাসান। আর মেয়ে সবার ছোট আতিয়া নূর।

প্রথম তিন ছেলে বিয়ে করেছেন। দুই ছেলে দেশের বাইরে। হাসান ইকরাম সুইডেনে হিউম্যান রাইটস-এর ওপর পড়াশোনা করছেন। আর হাসান জামান টেলিকমিউনিকেশনের ওপর পড়াশোনা শেষ করে মালয়েশিয়াতেই চাকরি করছেন।

বড় ছেলে হাসান ইকবাল বন্ধ হয়ে যাওয়া দিগন্ত টেলিভিশনের রিসার্চ ডাইরেক্টর পদে কর্মরত ছিলেন। দেশে থাকা আরো দুই ছেলে হাসান ইমাম এবং আহমেদ হাসান চাকরি করেন।

কামারুজ্জামানের মেয়ে আতিয়া নূর মনিপুর স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। স্ত্রী নূরুন্নাহার লেখালেখি করেন। কামারুজ্জামানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ঢাকার মিরপুরে সাংবাদিক আবাসিক পল্লীতে একটি ছয়তলা বাড়ি, শেরপুর শহরে একটি বাড়ি, শেরপুর ও গাজীপুরে জমি এবং কামারুজ্জামানের উত্তরাধিকার সূত্রে শেরপুরের গ্রামের বাড়িতে পাওয়া জমি ও বাড়ি রয়েছে।

জামায়াতের নেতৃত্বে কামারুজ্জামান : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কামারুজ্জামান কিছুকাল আত্মগোপেনে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জামায়াতের রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিলে কামারুজ্জামান ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন।

১৯৮১-৮২ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা মহানগরী জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তাকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যমন্ত তিনি জামায়াতের সিনিয়র সহকারি জেনারেলের পদে ছিলেন।আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত কামারুজ্জামান জামায়াতের আর্ন্তজাতিক বিষয় দেখাশুনা করতেন।

বিচারের মুখোমুখি কামারুজ্জামান : বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথমে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে বিচারের আওতায় আনা হয়।

এরপর ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একই বছর ২ আগস্ট তাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

২০১৩ সালের ৯ মে জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা এবং খুনের অভিযোগসহ মোট পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় ঘোষণা করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান আপিল করলে গত বছরের ৩ নভেম্বর বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সোহাগপুরে গণহত্যার দায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ফাঁসির রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এরপর গত ৫ মার্চ ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন কামারুজ্জামান।

মৃত্যদণ্ড কার্য্কর : এ বছরের ৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়ে মৃত্যদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ৮ এপ্রিল রিভিউ খারিজের রায় কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পর তা কামারুজ্জামানকে পড়ে শোনানো হয়। এরপর জেল কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানের কাছে জানতে চান তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি না। কামারুজ্জামান ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানালে ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। অবশেষে রাত ১০ টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যদণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্যে দিয়ে কামারুজ্জামানের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।



মন্তব্য চালু নেই