কাউন্সিলে চাঙ্গা হলো কি বিএনপি?

‘কি জানি কী হয়’ এই দোলাচলেই শেষ হলো বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। সারা দেশের মানুষ আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়েছিল ১৯ মার্চের দিকে। সরকার কাউন্সিল করার স্থান দেবে কি না, দিলেও নেতাকর্মীরা আসতে পারবে কি না ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিএনপি বারবার অভিযোগ জানিয়ে আসছিল সরকার কাউন্সিল করতে বাধা দিচ্ছে আর সরকারও বিএনপি নাশকতা করছে এমন অভিযোগ করে আসছিল।

শেষ পর্যন্ত সরকারের সহযোগিতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি এবং বিএনপিও এত বড় আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে কোনো গণ্ডগোল ছাড়াই শেষ করতে পেরেছে। দুই দলই মুখে মুখে যতই একে অপরকে দোষারোপ করুক পরস্পরের এমন সহিষ্ণু আচরণ দেশের মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে।

এখন টক অব দ্য টাউন বিএনপি এই কাউন্সিল থেকে কী পেল? কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত এবং দিনভর দেশের মানুষই নয় দলের নেতাকর্মীরাও ভেবেছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা হবে কিংবা অন্তত মহাসচিব ভারমুক্ত হবেন। কিন্তু সবাইকে হতাশ করে বিএনপির কাউন্সিল শেষ হলো চেয়ারপারসনের হাতে কমিটি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘তামাশার কাউন্সিল করেছে বিএনপি। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বিএনপিতে চলে পরিবারতন্ত্র।’ যদিও আওয়ামী লীগও এই পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে বিএনপির কাউন্সিলে একবারেই শূন্য হাতে দলের নেতাকর্মী ঘরে ফিরেছে এমনটা মনে হয় না। বরং বলা যায়, কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপি একটা সুযোগ পেয়েছে নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে বের করে আনার। আর কাউন্সিলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল বিকেলের অধিবেশন, যেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের নানামুখী চাপের মুখেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পেরেছেন দলের চেয়ারপারসনের সামনাসামনি কথা বলতে। যদিও তাদের এই কথার কতটুকু প্রতিফলন ঘটকে কমিটি গঠনে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু যতটুকু বলা গেছে তাতেই সন্তুষ্ট তৃণমূল। কারণ গুলশানে চেয়ারসপারসনের কার্যালয়ে অফিস সহকারীদের প্রাচীর ডিঙিয়ে নেত্রীর কাছাকাছি যাওয়িার সুযোগ পান না তাঁরা।

কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন তৃণমূলের নেতারা। হঠাৎ করেই গত বছরের ৫ জানুয়ারির আন্দোলন কেন বন্ধ করা হলো তার জবাবও জানতে চান জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া কমিটি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। নিয়মিত নির্বাহী কমিটির সভা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ বিএনপিকে ‘লিমিটেড কোম্পানি’ ঘোষণা করার কথাও বলেছেন এক নেতা। দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘এক নেতার এক পদ’-এর বিধান রেখে দলীয় গঠনতন্ত্রও অনুমোদন করা হয়। উত্থাপিত প্রস্তাবগুলো কাউন্সিলরদের কণ্ঠভোটে পাস হয়। প্রস্তাব উত্থাপনের আগে অন্তত ১৪ জন কাউন্সিলর বক্তব্য দেন। এতে কয়েকজন কাউন্সিলর জেনে-শুনে-বুঝে সময় নিয়ে কমিটি দিতে দলীয় প্রধানের কাছে অনুরোধ জানান।

কেউ কেউ দলের সংস্কারপণ্থীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁরা বলেন, সংস্কারপন্থীরা বেইমান। এদের দলে নেওয়া যাবে না। কারণ সুযোগ পেলে তারা আবার বেঈমানি করবে। এর জবাবে খালেদা জিয়া সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘আপনারা তৃণমূলের কমিটি থেকে বেঈমানদের বের করে দিন। আমি কমিটি গঠনের সময় মোনাফিকদের রাখব না।’ তিনি বলেন, ‘গতবার ঢাকায় আন্দোলন হয়েছে, আমি স্বীকার করছি। কিন্তু কিছু বেঈমান ও মোনাফিকরা আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তা বন্ধ করে দেয়, যার কারণে আন্দোলন সফল হয়নি। আগামী দিনে কর্মসূচি গ্রহণের আগে তৃণমূলের মতামত নেওয়া হবে।’ বেগম জিয়া বলেন, ‘আমি আপনাদের তৃণমূলের কমিটি করতে বলেছি। আপনারা সব করতে পারেননি। অনেকে পকেট কমিটি গঠন করেছেন। লেনদেন ও ভাইয়ের কমিটি এ দলে হবে না। আপনারা দায়িত্ব দিয়েছেন আমি যোগ্যদের দিয়ে কমিটি করব।’

বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘১/১১-এর বিশ্বাসঘাতক ও বেঈমানদের দলে ঠাঁই দেওয়া ঠিক হবে না।’ গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবীর খান বলেন, “২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি কেন হলো না, তার জবাব চাই। অতীতের আন্দোলনগুলোয় কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে থাকেননি। নেতাদের পাসপোর্ট চেক করা উচিত। ওই সময় কে কোথায় ছিলেন, তার জবাবদিহিতা নেওয়া উচিত। এক যুগ ধরে জেলা ছাত্রদলের কমিটি হয় না। চার-পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করেছি। তাও কমিটি নিতে পারিনি। বছরের পর বছর নির্বাহী কমিটির বৈঠক হয় না। যদি মিটিং না হয়, তাহলে বিএনপিকে ‘লিমিটেড কোম্পানি’ ঘোষণা করা হোক।”

নওগাঁ জেলা বিএনপির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ‘বিগত ৫ জানুয়ারির আন্দোলনের সময় নেতারা কে কোথায় ছিলেন, তা চিহ্নিত করা হোক। আমার জানা মতে, অনেকেই মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন। তাদের ব্যাপারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেন ও বিগত ৫ জানুয়ারি আন্দোলনের পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন পদপদবিতে তাঁদের সামনের সারিতে নিয়ে এলে দলের জন্য মঙ্গল হবে।’

এত ছোট মিলনায়তনে তিন হাজার কাউন্সিলরের জায়গা না হওয়ায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণেও তা সম্প্রসারণ করা হয়। সেখানে বড় পর্দার মাধ্যমে মিলনায়তনের ভিতরের অনুষ্ঠান দেখানো হয়।বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। শেষে কাউন্সিলরদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন তিনি।আর নেতাকর্মীদের সান্ত্বনা এখানেই তারা কিছুটা হলেও নেত্রীর কানে কথা তুলতে পারলেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্লোগান নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলটি।৩৭ বছর বয়সী দলটির গঠনতন্ত্রে আছে প্রতি তিন বছর পর কাউন্সিল বা জাতীয় সম্মেলন হবে। এর আগের সম্মেলন হয়েছে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে।যদিও এই দীর্ঘ বিরতির জন্য বিএনপির নেতারা বর্তমান বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের দোহাই দেন। কিন্তু বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো কাউন্সিল করতে আগ্রহ দেখায়নি তারা। একই কথা প্রযোজ্য আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও।

এবারে আওয়ামী লীগ তাদের সম্মেলন করতে পারবে কি না এরইমধ্যে তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেউই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলে না, চলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের খেয়ালখুশি মতো। তারা যখন চাইবে তখন কাউন্সিল হবে, না চাইলে হবে না। আর কাউন্সিল করলেও বা কি আসে যায়! কোনো গুণগত পরিবর্তন হয় কি?

বিএনপির কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তার কোনো প্রতিনিধি তো পাঠায়ইনি, উল্টো সৈয়দ আশরাফ বললেন, দাওয়াতই দেয়নি বিএনপি। তবে আওয়ামী লীগ চাইলে একটা সুযোগ নিতে পারত এই সম্মেলনে। তাদের কোনো প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিএনপিকে একটা আহ্বান জানাতে পারত এই বলে যে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছেড়ে বিএনপি তার বদনাম ঘুচিয়ে রাজনীতির মাঠে এলে আওয়ামী লীগ তার প্রতিপক্ষকে সাদরে গ্রহণ করবে, কোনো মামলা থাকবে না নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এর ফলে বিএনপির নেতাকর্মীরা নতুন করে ভাবার সুযোগ পেত, কেন্দ্রের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দলটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করতে পারত। আওয়ামী লীগ এই সুযোগটা হাতছাড়া করল।

আর ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের নামে বিএনপি যেটা করল আসলে এটাকে একটা বড় সমাবেশ বলা যায়। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ড এখন বিএনপির ঝোলায়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন, টানা তিন মাসের অবরোধ কর্মসূচি এবং মার্চ ফর ডেমোক্রেসি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভরাডুবি এসব কয়টি কার্যক্রমে বিএনপির ব্যর্থতার বড় কারণ নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। তাহলে ১৯ মার্চের সম্মেলনে এত মানুষ এলেন কীভাবে? শুধু কেন্দ্রীয় নেতাদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। রাজনৈতিক দলের কর্মী হলেও তারা মাঠে কষ্ট না করে টাকা দিয়ে পদপদবি কিনতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। মিছিল মিটিংয়ে থাকার চেয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করার মধ্যেই তাদের কর্মযজ্ঞ শেষ হয়। অনেকেই আসেন টিভি ক্যামেরার সামনে নিজেকে দেখানো প্রতিযোগিতা করতে। তাই যদি না হয়, তাহলে দলের নেত্রীর ডাকে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? টাকা দিয়ে পদ-পদবি কেনার এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে বিএনপিকে আরো চরম মূল্য দিতে হবে। কারণ, জনগণ এখন সবই বোঝে, উটপাখির মতো বালুতে মুখ না গুজে নিজের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে বিএনপির।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ



মন্তব্য চালু নেই