কল্যাণপুরের জঙ্গিরা ভয়েস রেকর্ডে যা বলে গেছে
কল্যাণপুরের অভিযানে নিহত হওয়ার আগে জঙ্গিরা কেবল ছবি তোলেনি, তারা প্রত্যেকের ভয়েসও রেকর্ড করেছিল। এসব রেকর্ডে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা সবাইকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। ভয়েস রেকর্ডের কিছু করা হয় ‘কথিত আইএসএ’র কাছে দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য। কিছু করা হয় জঙ্গিদের মা-বাবার উদ্দেশে।
কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধার বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন সেট, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষা করে এরই মধ্যে এ ধরনের রেকর্ড পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা সেখান থেকে সব অডিও আর ভিডিও রেকর্ড বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে জঙ্গিদের কথিত আইএস সেজে তোলা কিছু ছবি তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে পাওয়া গেছে। সেখানে অস্ত্র হাতে তাদের হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা গেছে।
কল্যাণপুরে অপারেশন স্টর্ম-২৬-এর রাতে আস্তানার ভেতর থেকে জঙ্গিরা যে ধরনের জিহাদি বক্তব্য ও স্লোগান দিচ্ছিল, তা আশপাশের এলাকার একাধিক মানুষ শুনেছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে জঙ্গিরা হুমকি দিচ্ছিল, ‘সাহস থাকলে বুলেটপ্রুফ পোশাক রেখে আয়।’ আশপাশের ভবন থেকে যেসব প্রত্যক্ষদর্শী জঙ্গিদের এসব কর্মকাণ্ড দেখেছেন তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
এদিকে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় টার্গেট কিলিংয়ের মূল পরিকল্পনাকারী একজন গোয়েন্দা নজরে রয়েছে। তার বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। অন্তত ৩০টি হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তার যোগসূত্র পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গুলশানের হামলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ ছাড়া কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর বাড়িতে যে ১১ জঙ্গি অবস্থান করছিল তাদের ব্যাপারে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়েছে। একজনকে আহতাবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে; একজন পালিয়েছে। সেখানে অবস্থান করা ১১ জনের সবাই ওই বাড়ির বাসিন্দা ছিল না।
তবে ওই আস্তানায় মাঠ পর্যায়ের জঙ্গিদের আরও ৯ পরামর্শদাতা, অর্থদাতা ও প্রশিক্ষক আসা-যাওয়া করত।
কল্যাণপুরের ‘জাহাজ বিল্ডিংয়ের’ ১০০ গজের মধ্যে আরও দুটি আস্তানায় তাদের যাতায়াত ছিল। ওই দুই আস্তানায় এরই মধ্যে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, কল্যাণপুরের আস্তানা পুলিশ ঘেরাও করার পর এক পর্যায়ে জঙ্গিরা তাদের ফ্ল্যাটে থাকা বেশ কিছু কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে। পুড়িয়ে ফেলা কাগজপত্রের মধ্যে জঙ্গিদের কয়েকজনের সনদ ছিল।
এ সময় তারা চিৎকার করছিল আর বলছিল, ‘সারাদেশের শিক্ষার্থীরা, তোমরা যে বিদ্যা অর্জন করছ তা চাকর হওয়ার জন্য। তোমরা জিহাদের পথে আস। প্রাচুর্যের আলো ফেলে তোমরা জিহাদে অংশগ্রহণ কর।’
এ ছাড়া জঙ্গিরা তাদের অভিভাবকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখে। সেখানে বলা হয়, ‘তোমরা ভুল পথে হাঁটছ। আমরা সঠিক পথে রয়েছি। তোমরা দাওয়াতের পথে এসো।’
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, শুধু গুলশান ও কল্যাণপুরের ঘটনায় জড়িতরা আইএস মতাদর্শী সেজে ছবি তোলে রাখেনি, এর আগে হোসেনী দালানে হামলার ঘটনায় জড়িতরাও কথিত ‘আইএস’ সেজে ছবি তুলেছিল। তারা টাঙ্গাইলের মধুপুর জঙ্গলে ছবি তুলেছিল। এ ছাড়া গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কল্যাণপুরের বাসা থেকে পলাতক ইকবাল জেএমবির একজন বড় মাপের নেতা। বাসা থেকে পালানোর সময় তার কাছে একটি একে-২২ রাইফেল ছিল। সব মিলিয়ে জেএমবির ১০-১২ জন শীর্ষ নেতা বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তাদের কাছে অন্তত ৪-৫টি একে-২২ রাইফেল রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
তবে এরই মধ্যে গাইবান্ধার একজন শীর্ষ জেএমবি নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। গোয়েন্দাদের মতে, পলাতক জঙ্গিরা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত আরও হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র বলছে, এর আগেও বিভিন্ন সময় জঙ্গি আস্তানা থেকে যেসব জঙ্গি পালিয়েছিল তারা অনেক নথিপত্র বাসায় রেখে গেলেও একে-২২ নিয়ে যায়।
এর আগে রায়হান কবির ওরফে তারেক নামে এক জেএমবি নেতার আস্তানায় তিন দফা অভিযান চালানোর পরও তাকে অস্ত্রসহ ধরা যায়নি।
জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড নিয়ে খোঁজ রাখেন এমন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘জাহাজ বিল্ডিংয়ে’ যে ১১ জন জঙ্গি অবস্থান করছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন শেওড়াপাড়ায় একটি আস্তানায় কি?ছু দিন ছিল।
এ ছাড়া মিরপুর এলাকায় জঙ্গিদের আরও কয়েকটি আস্তানা রয়েছে। কেন মিরপুর এলাকায় এত জঙ্গি আস্তানা এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, উত্তরাঞ্চল থেকে অনেক জঙ্গি গাড়িতে এসে গাবতলীতে নামে। তাই তাদের জন্য গাবতলীর আশপাশ এলাকায় বাসা ভাড়া নেয় সঙ্গীরা।
এ ছাড়া মিরপুর এলাকায় অনেক ঘিঞ্জি পরিবেশ রয়েছে। এমনকি ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় সেখানে তুলনামূলকভাবে বাসা ভাড়া কম। তাই জঙ্গিদের অনেকে মিরপুরকে বেছে নেয়। এর আগে মিরপুরের শাহআলী, শেওড়াপাড়া ও মিরপুর-১ নম্বরে জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পাওয়া গেছে।
তবে মিরপুরের বাইরেও অনেক এলাকায় জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। ২০ জুলাই পুলিশের কাছে প্রথম তথ্য যায়, কল্যাণপুরে একটি বড় ধরনের জঙ্গি আস্তানা রয়েছে। এরপরই এই তথ্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হয়। একাধিক ব্লক রেইড দিয়েও মূল জঙ্গি আস্তানার সন্ধান প্রথমে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত ২৫ জুলাই ব্লক রেইড দেওয়ার পরপরই জঙ্গি আস্তানার খোঁজ মেলে।
টার্গেট করা তরুণদের যারা দলে ভেড়াচ্ছে তারা নানা কৌশল নেয়। একই জায়গায় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আলাদা আলাদা গ্রুপে ভাগ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের অনেক জঙ্গিকে বাসার বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাদের সব আস্তানা সম্পর্কেও জানানো হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জঙ্গিরা যে কোনো অপারেশনের পর তাদের ছবি পাঠায় তামিম চৌধুরীর কাছে। তার হাত ধরে তা দেশের বাইরে যায়। কল্যাণপুরের ঘটনায় যে দশজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে তার মধ্যে কানাডাপ্রবাসী এই তামিম চৌধুরী রয়েছে।
২০১৩ সালে কানাডা থেকে দেশে ফিরে উগ্রবাদে জড়ায় সে। এ ছাড়া নারী জঙ্গিদের ব্যাপারে তথ্য নিতে দুটি গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করেছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ধর্মের যেসব ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয় এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত জঙ্গি আস্তানা থেকে পাওয়া গেছে। জঙ্গিদের ভাষায়, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা ‘বেহেশতে যাওয়ার গাইডলাইন’ তৈরি করেছে। এসব গাইডলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরা তরুণদের মগজধোলাই করছে।-সমকাল
মন্তব্য চালু নেই