কথায় নয় কাজে বাঙ্গালী-এটাই হোক নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত। আগেকার দিনে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নানা আয়োজন থাকতো। কিন্তু কয়েক বছর থেকে নববর্ষকে পাশ কাটিয়ে পহেলা বৈশাখ বলার রীতি চালু হয়েছে। নববর্ষ উদযাপনে মানুষের মনে থাকে নানারকম পরিকল্পনা। কীভাবে নতুন বছরের প্রথম দিনসহ সারাবছর অতিবাহিত করবে। পাশাপাশি পুরনো বছরের যত সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাবে। পাওনাদারদের দেনা পরিশোধ করবে, ব্যবসায়ীরা বকেয়া টাকা এক দিনের জন্য হলেও নগদ পাবে। দোকানে-দোকানে পালিত হবে হালখাতা উৎসব। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সবার মাঝে শুরু হবে নতুন গান, নতুন জীবন। কিন্তু বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষ এ ধরনের চিন্তা লালন করেন না। নতুন বছরে ঋণ পরিশোধ করাও যে বাঙালির সংস্কৃতির অংশ তা যেন ভুলেই যাওয়া হচ্ছে।
অধিকাংশ মানুষ যেন তার নৈতিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। পাওনা টাকা দ্রুত পরিশোধ করা যে তার আবশ্যক সেকথা ভুলেই গেছেন। বরং অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতাকে খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছে জীবনের সাথে। যার কারণে মৌলিক দায়িত্বগুলো পালন করা হচ্ছে না। কোন কিছু ভালোভাবে না জেনেই অন্য ধর্মের রীতি-নীতি ও পশ্চিমা সংস্কৃতিকে বাঙালির সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
কোন প্রাণীর ছবি কিংবা মুখোশ কখনোই কোন ব্যক্তির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তবুও নানা প্রাণীর মুখোশ পড়া মিছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিতি লাভ করছে। পশু-পাখির মুখোশ ও প্রতিকৃতিকে ভাগ্য নিয়ন্তা মনে করা হয় যা শিরক বা অংশিদারিত্বের নামান্তর। প্রকৃত কোন মুসলিম মঙ্গল শোভা যাত্রাকে কল্যাণের উপকরণ মনে করতে পারেন না। মানুষ শ্রেষ্ঠ জাতি সেকথা ভুলে গিয়ে বন্য পশুর মুখোশ পড়ে নিজেকে ধন্য মনে করছে, এ যেন অজ্ঞতা বৈ কিছুই নয়। এ দেশে ৮৮% মুসলমানের দেশ হওয়ার পরেও মঙ্গলযাত্রায় নামধারী মুসলিমের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া আনন্দ উৎসবের নামে নারী-পুরুষের একত্রে নাচ-গান, পরস্পরে ধরা-ধরি, হাসা-হাসি, নির্জনে সময়দানসহ নানা বেহায়াপনা কর্মকা- যেন আনন্দের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কেউ কেউ এধরনের উৎসবকে ‘নগ্ন উৎসব’ নাম দিয়েছেন।
মুসলিম হয়ে বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি গ্রহণ না করে যারা বাঙালি হিন্দুরীতি গ্রহণ করছে, তারা কী ধরনের মুসলিম সেটা তিনিই ভালো জানেন। যারা সন্তানকে বাংলা শিখতে নিরুৎসাহিত করেন তাদেরকেই আবার দেখা যায় এক দিনের জন্য বাঙালি হওয়ার ভান করতে। শুধু তাই নয়, ফসলের মৌসুমকে কেন্দ্র করে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন চালু হলেও সরকারের কোষাগারে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ক্ষেত্রে চলে প্রতিযোগিতা ও নানা ছলচাতুরী। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, পান্তা-ইলিশ ভোজন আর পোশাকে কৃত্রিম বাঙালি না হয়ে প্রকৃত দেশপ্রেম থাকাই বাংলাদেশের বাঙালিদের বড় পরিচয়। বর্তমান সময়ে পান্তা-ইলিশ উৎসব করা গরিবদের সাথে উপহাস করার নামান্তর।
বৈশাখী অনুষ্ঠান আনন্দের হলেও মাঝে মাঝে তা বেদনায় পরিণত হয়। গত বৈশাখের প্রথম দিনটি অনেকেরই হয়তো খুব আনন্দে কেটেছে, কিন্তু সেন্টমার্টিনে সমুদ্রে গোসল করতে গিয়ে ইভান ও সাদ্দামসহ কয়েকজনের মৃত্যু ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার পর তাদের পরিবারগুলো কীভাবে দিনটি কাটালো একবারের জন্য হলেও বিবেককে প্রশ্ন করে দেখুন, এখান থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেয়া উচিৎ। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে বোমা হামলার ১৪ বছর পূর্ণ হলো, অথচ বিচার যেন শেষ হয়েও হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নির্ঘুম রাত পার করছে একটি ন্যায় বিচারের আশায়। শেষ পর্যন্ত তারা সত্যিকারার্থে পাবে কি ন্যায় বিচার? এক বোমা হামলার বিচার পেতে না পেতেই আবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে- “শেরপুর মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ, বোমার আলামত জব্দ” (কালের কন্ঠ, ১৪ এপ্রিল ’১৪)। এ ধরণের ঘটনাবলী ভালো কোন লক্ষণ নয়।
কথা আর পোশাকে বাঙালি না হয়ে কাজে বাঙালি হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন। বাংলা ১২ মাসের নাম নির্ভুলভাবে লিখতে না পারা লোকের সংখ্যাও কম নয়। পহেলা বৈশাখের দিনটি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ কোনটি করণীয় আর কোনটি বর্জনীয়। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ধর্মকে উপেক্ষা, মুসলিম হয়ে অমুসলিমের অনুসরণ, নারী-পুরুষের সম্মিলিত নাচ-গান আর সকল প্রকার নগ্নতা ও বেহায়াপনা থেকে দূরে থাকা, সময় ও সম্পদের অপচয়, অপরের দোষ বলা থেকে বিরত থাকা, বিদেশী পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা, নিম্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে উপহাস, গরম ভাতে পানি দিয়ে নিজের সাথে উপহাসসহ নানা অপসাংস্কৃতিক কর্মকা- বর্জন করা প্রয়োজন।
আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মুসলিম, আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাঙালি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত করা। লেন-দেনে স্বচ্ছতা আনয়ন, দেশীয় পণ্য ব্যবহার, সবার সাথে উত্তম আচরণ, নির্ভুল বাংলা বানান ও উচ্চারণসহ ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থ না দেখে দেশের স্বার্থে কথা বলা এবং দেশের স্বার্থে কাজ করা, ‘কথায় নয় কাজে বাঙালি’ এটাই হোক নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা।



















মন্তব্য চালু নেই