‘ওরাতো আমাদের অনেকটা মেরেই ফেলেছে’

ভারতের উত্তরপ্রদেশে একের পর এক ‘অবৈধ’ কসাইখানা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ওই প্রদেশটিতে এমন সব মাংস ব্যবসায়ী ও কসাই রয়েছেন যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাজটিই করে আসছেন। কসাইখানা বন্ধে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়ছে তাদের ওপর?

বিবিসির সাংবাদিক বিকাশ পান্ডে আহমেদাবাদ শহর ঘুরে দেখেছেন সেখানকার ব্যবসায়ী ও কসাইরা এখন কর্মহীন অবস্থায় অর্থকষ্টে দিন যাপন করছেন। “দু’সপ্তাহ আগে আমার দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে আমার হাতে কোনও টাকা নেই। আমার বৃদ্ধ বাবা-মা ও সন্তানদের কিভাবে খেতে দিব আমি জানিনা। কেন এমন হচ্ছে? আমি মুসলিম বলে? নাকি আমি মাংস ব্যবসায়ী বলে আমার কপালে এমন হলো?” -বলছিলেন ৫২ বছর বয়সী শাকিল আহমেদ।

রাজ্যটির নতুন মুখ্যমুন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ওপর নিজের ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পুলিশকে নির্দেশ দেন সমস্ত অবৈধ কসাইখানা এবং মাংসের দোকানে তালা লাগিয়ে দিতে। নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ক্ষমতায় এলে তারা ‘অবৈধ’ কসাইখানাগুলো বন্ধ করে দেবে।

কিন্তু মাংস ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, বৈধ-অবৈধ তোয়াক্কা না করেই সব কসাইখানা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের বেশিরভাগ মাংস ব্যবসায়ী মুসলিম। অনেকে বলছেন যারা মুরগী ও ছাগলের মাংস বিক্রি করেন তাদের দোকানও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে সেখানে মাংস ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠনও ধর্মঘট পালন করছে, তাদের দাবি রাজ্যে নতুন বিজেপি সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে তাদের ওপর হেনস্তা হচ্ছে।

শাকিল আহমেদ বলছেন, “গরুর মাংস বিক্রি বন্ধের জন্য বিজেপির প্রতিশ্রুতির বিষয়টি তিনি বুঝেন। কিন্তু যেসব দোকান মুরগীর মাংস বিক্রি করে বা ছাগল বা ভেড়ার মাংস বিক্রি করে তাদের কী দোষ? তারা কেন ভুগবে? জীবন বাচানোর অন্য পথও তো তাদের জানা নেই। কারণ কয়েক দশক ধরে এই ব্যবসাই তারা করে আসছে”।

তিনি জানালেন যে নতুন করে লাইসেন্স করার আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছে মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ। শাকিল আহমেদ যে এলাকায় বাস করেন সেটি খুব ঘনবসতি এলাকা। নয় সদস্যের পরিবারকে নিয়ে দুটো রুমে বাস করেন তিনি। তার এলাকয় মূলত মুসলিম কুরেশি সম্প্রদায়ের মানুষজন বাস করেন।

শাকিল আহমেদের মা ফাতিমা বেগম বলছেন, এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ মাংস ব্যবসার সাথে জড়িত। ‘এখানকার পুরুষদের অন্য কোন কাজ জানা নেই। আমাদের অবস্থা খুই খারাপ এখন। প্রত্যেক বেলায় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে খাবারটা কোথা থেকে জোগাড় হবে। ওরাতো আমাদের অনেকটা মেরেই ফেলেছে।’

ফাতিমা বেগম বলছেন -তার কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার টাকা পর্যন্ত নেই। আরএ বিষয়টি তার ছেলেকে জানাননি কারণ তিনিতো বুঝতে পারছেন ছেলে কিসের মধ্যে আছে। শাকিল আহমেদের স্ত্রী হুসনা বেগম ভয় পাচ্ছেন টাকার অভাবে তার সন্তানদের পড়ালেখা না বন্ধ হয়ে যায়।

“আমি চাই ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করুন, আমাদের অভাব ঘুচুক। সরকার যদি মনে করে মাংসের দোকান খারাপ তাহলে আমাদের অন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিক”-বলছিলেন তিনি। শাকিল আহমেদ যে গলিতে থাকেন তার পরের গলিতে বাস করেন মো: শরিক। তিনি বলছেন, দশ দিন ধরে তিনি কাজে যাননা। “আমার কাছে কিন্তু দোকান চালানোর লাইসেন্স আছে। কট্টরপন্থীদের হামলার ভয়ে আমি দোকান খুলি না।”

মো. শরিকের ভয় অমূলক নয়। গত দুই সপ্তাহে অনেক মাংসের দোকানে হামলার খবর পাওয়া গেছে। তার ঘরেওআছে দশ জন মানুষ, তাদের কিভাবে চালাবে এ চিন্তায় তার দিন কাটছে। মো. শরিকের মতো তার ভাই পি কুরেশিও উদ্বীগ্ন। সবাই ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। পি কুরেশির পরিবারের সদস্যও ১০ জন, তার আয়ের ওপরেই সবাই নির্ভরশীল।

এই এলাকার সব পরিবারের প্রায় একই ধরনের কাহিনী। আবদুল কুরেশি তার ভ্যানে করে মুরগি বিক্রি করতেন, তিনিও দশ দিন ধরে কাজ করতে পারছেন না। এমন অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজছেন সবাই। অনেকে বলছেন, তারাতো আহামরি কিছু চাইছেন না, সরকারকে একটা উপায় বের করে দিতে হবে যেন তার দৈনন্দিন জীবনে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারেন। – বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই