এসেছে নবান্নের অগ্রহায়ন, পড়েছে কি পিঠা উৎসবের আমেজ?

সৌরভ আদিত্য, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি : ভোরে বেলার কাচা ঘুমকে তাড়াতে আমি একটু বেশি পটু। তা যেন আমার নিত্য দিনের একটা কর্মে পরিনত হয়েছে। সেই ধারাকে অব্যাহত রেখে চলেছি। যদিও শীতের সকালে তা সবার জন্যই একটু কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবুও আমি হার মানতে নারাজ। ঘুমকে পরাজিত করে ভোরের কুয়াশাকে স্বাগত জানাতে আমি প্রতিদিন প্রস্তুত থাকি। শুধু কুয়াশাকেই নয়, কুয়াশাকে বিদায় জানিয়ে শীতের প্রহরের প্রথম সুর্যকেো আমি স্বাগত জানাই । এ যেন আমার নিত্যকর্মের অংশ বিশেষ। কুয়াশাকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় জানানো, অপরদিকে শীতের প্রথম প্রহরের সুর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্যে যতটুকু সময় অতিবাহিত হয় তার মধ্যে থাকে অজানার পথে ছুটে চলা, থাকে অজানাকে জানা।

আজও এক অজানাকে জানতে ছুটেছিলাম গ্রামের মেঠোপথ ধরে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ নজর কাড়ে গ্রামীন কৃষকরা। দেখলাম গ্রামের কৃষকের মধ্যে রঙিন উৎসবের ছোঁয়া আছে কিন্তু নেই যেন প্রানবন্ত সেই খুশীর আমেজ । আমার খুব ইচ্ছে করে সেই আগের মতো নবান্ন উৎসবে সেজে উঠুক বাংলার প্রতিটি কৃষকের ঘর। নবান্দ উৎসব পালিত হউক পূর্বের ন্যায় সেই হাসি-খুশির মধ্যে দিয়ে। তারা তাদের ঘাম ঝরা ফসলের ন্যায্য মুল্যের প্রাপ্তির মাঝে আনন্দ মন খুলে হাসুক। সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার সোনালী ফসল ধান উৎপাদনের আগেকার আমলের সকল কলাকৌশল। আগে ধান কেটে গরু দিয়ে মাড়া দেওয়া হতো। ঢেঁকি দিয়ে চাল ভেঙে পিঠা তৈরি করা হত। যারা শহরে বড় হয়েছে তারা নবান্ন উৎসব বলতে বুঝে নানারকম পিঠা উৎসব বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডালা, কুলা নিয়ে নাচ গান। আসলে নবান্ন মানে কি তাই?

নবান্ন উৎসব কি?

নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সে ধান থেকে পাওয়া চালে প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে পায়েস রান্না করা হয়। এভাবে নানা আয়োজনে পালিত হত নবান্ন উৎসব।

হিন্দু রীতিতে, নবান্ন অনুষ্ঠানে নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারের সদস্যবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। শহুরে মানসিকতার কাছে মার খাচ্ছে গ্রামীণ মূল্যবোধ। তাই নবান্নের অনেক আচার-অনুষ্ঠান এখন আর দেখা যায় না কিংবা যেটুকু দেখা যায় সেখানে ঐতিহ্যের অনেক উপাদান থাকে অনুপস্থিত। কয়েক যুগ আগেও নবান্নের শুরুটা হতো সোনালী আমন ধান কেটে তাকে খুশী মনে আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে। তখন বাংলার কৃষকদের প্রধান উৎপাদন শস্য ছিল আমন ধান। এখন আমাদের দেশে নানা জাতের দেশি,বিদেশি আমদানি করা ধান
ফলে!

প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী অগ্রাহায়ণের প্রথম দিন আমন ধান কাটা দিয়ে নবান্ন উৎসব শুরু হতো। এই সময় কৃষকের ঘরে ঘরে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধে বাতাস মাতাল হতো। নতুন চালের ক্ষীর, পিঠাপুলি দিয়ে চলত নবান্ন বরণের আয়োজন। একটা সময় ছিল খুব ধুমধামের সাথেই এই উৎসব পালন করা হতো। ধান কাটা শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হতো বিভিন্ন পালা- পার্বণ। হাসি খুশী আর আনন্দে ভাসতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী চলতো খাওয়া দাওয়ার, রান্নার ধুম। এই সময় পুরো গ্রাম জুড়েই চলত খুশীর জোয়ার। যেন পুরো গ্রাম ছিল এক,একটি পরিবার।ঢেঁকিতে ছাটা হতো নতুন ধান। সেই চালেই তৈরী হতো নানারকম মুখরোচক পিঠা পায়েশ, নানান জাতের পিঠ বানিয়ে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে খুশির বন্টন। কালের পরিবর্তনে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু আজো বাংলার অনেক গ্রামের ঘরে নবান্ন উৎসব হয়। কিন্তু আগের সেই ছন্দময় ঐতিহ্যর ছোঁয়া নেই। নেই মুখরিত আঙিনা। সব যেন যান্ত্রিকতায় মোড়া অন্য এক নবান্ন।



মন্তব্য চালু নেই