এসপির জন্য এক অন্যরকম ভালোবাসা

বগুড়ার শাজাহানপুরের রিকশাচালক সফিকুল মিয়া। ১০ কিলোমিটার দূরের পথ মাড়িয়ে ১ জুন সোমবার সকালে শহরে এসেছেন পুলিশ সুপার (এসপি) কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য বিদায়ী এসপি মোজাম্মেল হককে একনজর দেখা। বিদায়ী এসপির জন্য তিনি উপহার হিসেবে এনেছিলেন কষ্টের টাকায় কেনা একটি ছাতা। এই ভালোবাসার কারণ একটাই। এলাকার সন্ত্রাস নির্মূলে এসপির দেওয়া বক্তব্য তাঁর খুব মনে ধরেছিল। এমন ভালো লাগার মানুষটি বগুড়া ছাড়বেন শুনেই তাঁর এ ছুটে আসা।

বগুড়ায় তিন বছর চাকরির পর ৩১ মে রবিবার শেষ অফিস করেন এসপি কৃষিবিদ মোজাম্মেল হক। এবার তিনি পাড়ি জমাচ্ছেন পাশের জেলা নওগাঁয়। রবিবার তাঁকে জেলার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা এক ব্যতিক্রমী বিদায় জানান। তাঁর ব্যবহৃত কালো পাজেরো গাড়িটি রশি দিয়ে টেনে ও ধাক্কা দিয়ে পুলিশ লাইন চত্বর থেকে বের করেন তাঁর সহকর্মীরা। জেলার সর্বস্তরের পুলিশ সদস্যরা এই বিদায় বেলায় উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পুলিশের বাদক দল বিদায়ী সুর বাজিয়ে তাঁকে সম্মান জানায়। পুলিশ সুপারের বিদায় বেলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঝড় ওঠে। বিদায়ের দিনে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর নানা কাজের প্রশংসা করে।

সালেহ ইমরাম নামের পুলিশের একজন উপপরিদর্শক (এসআই) তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘তিনি কেমন মানুষ ছিলেন তা আপনারাই বলুন। যিনি ১১ দিনে ২৩৪টি সংবর্ধনা ও ৩৫০টি ক্রেস্ট পেয়েছেন। ওনার সম্পর্কে কি আর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে! হ্যাঁ, তিনি দেশসেরা পুলিশ সুপার হয়েছেন। মানুষের সেবা করেই এই খ্যাতি অর্জন করেছেন। অবিরাম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং শুভকামনা রইল এই মহান মানুষটির জন্য।… আমরা চাইলেই এই সমাজ তথা দেশকে বদলে দিতে পারি। আমরা চাইলেই একটা পরিবর্তন আনতে পারি। যে পরিবর্তনের শুরুটা করে দিয়ে গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদায়ী পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান এবং বগুড়ার বিদায়ী পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক।’

অন্য এক পুলিশ সদস্য লিখেছেন, বগুড়া জেলা পুলিশ তাঁর কাছে ছিল এক অতি আপন পুলিশ পরিবার। এই পরিবারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল এবং সব সিভিল স্টাফ তাঁর কাছে অতিপ্রিয় ছিল। গত ৩৭ মাস এ কর্মক্ষেত্রে তিনি প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে সুখ-দুঃখ এবং আনন্দ অনুভূতি ভাগ করে নিয়েছিলেন।

বগুড়ায় পুলিশ সুপার হয়ে মোজাম্মেল হক যোগ দেন ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল। বগুড়ায় যোগ দেওয়ার পর থেকে পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বগুড়া পুলিশের পেশাগত মানোন্নয়নে সার্বিক কাজ করেছেন। তিন বছরেরও বেশি সময় তিনি বগুড়ায় সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বগুড়ার মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক সমাজসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল সখ্য। শুধু আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন নয়, বগুড়ার পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তিনি। পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার মানোন্নয়নে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যার ফলে পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি শিক্ষা, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রমে ছিল তাঁর পদচারণ। পুলিশ প্রশাসনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে আরো কর্মকর্তাসহ পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি। এ কারণে দেশসেরা পুলিশ সুপার হিসেবে ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি।

বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার (বি সার্কেল) গাজীউর রহমান বলেন, ‘গত তিন বছরে পুলিশ সুপার বগুড়া জেলায় অসংখ্য পুলিশি স্থাপনা নির্মাণ করেন। তিনি প্রতিটি থানার সীমানাপ্রাচীর ও দৃষ্টিনন্দন গেট নির্মাণ করে পুলিশি স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। ১৪টি পুলিশ ইউনিটে স্যালুটিং ডায়াস নির্মাণ করেন। বগুড়া পুলিশ লাইনসে দুটি দৃষ্টিনন্দন গেট, পুলিশ লাইনস মসজিদের এসএস বার দ্বারা নির্মিত প্রাচীর, পুলিশ লাইনসে নির্মিত ক্যান্টিন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন বাগান, হৃদয়ে বাংলাদেশ ও এনেক্স ভবন তাঁর কাজের উদাহরণ।’

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘তিনি জেলা পুলিশ অফিসসহ বিভিন্ন থানায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। বগুড়া পুলিশ অফিসে ওয়াই-ফাই জোন, বিভিন্ন থানা ও ইউনিটে ফ্যাক্স মেশিনের মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানে উৎসাহিত করেন। এ ছাড়া প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ই-মেইলের মাধ্যমে সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।’



মন্তব্য চালু নেই