এরশাদ হঠাৎ-ই অফিসমুখী

বাসায় বসেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এলাকার লোকজনদের ডিও লেটার (আধা-সরকারি পত্র) দেয়া, কাজের সুপারিশ এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলাই তার রুটিন ওয়ার্ক। সংসদে বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হলেও তিনি পার্টি অফিসে নিয়মিত ছিলেন না। নিতান্তই জাতীয় ও বড় ধরনের কর্মসূচি থাকলে তিনি পার্টি অফিসে ঢুঁ মারতেন।
পার্টি অফিসে যাবেনই বা কী করে? রাজনীতি ছাড়াও তো ওনার অনেক কাজ আছে। সবদিকেই অলরাউন্ডার এ নেতা গান লেখেন, কবিতা লেখেন, কখনো কখনো গল্প ও প্রবন্ধও তার কলমে বশ মানে। তাই লেখক হিসেবেও তার বেশ পরিচিতি। বিশেষ করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রেমীদের কাছে।
কিন্তু পার্টির একটা বৈঠকই এরশাদের সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। আর সেই এলোমেলো করে দেয়ার নায়কও আবার তার সহধর্মীনী বিরোধীদলীয় নেতা পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। রোববারের ওই বৈঠকের পর থেকে এরশাদ এখন পার্টির কার্যালয়ে বসেন এবং বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছেন। পার্টির দেখভাল এখন তিনিই করার চেষ্টা করছেন।
এদিকে সোমবার সকালে তিনি হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন পার্টির চেয়ারম্যানের পদ ত্যাগ করবেন। এরপর দুপুরে চলে যান বনানীর পার্টি অফিসে। কিন্তু নেতাদের অনুরোধের ঢেঁকি গেলায় আর তাকে পদত্যাগ করতে হলো না। উল্টো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হঠাৎ করেই পার্টির জন্য বেশ কর্মোদ্যগী হয়ে উঠেছেন।
জাপা সূত্র জানায়, রোববার দলের বৈঠকে সমালোচনার মুখে পড়ে এরশাদ গোস্যা করেন। আর সেই গোস্যার কারণেই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কারণ এর আগে কখনোই এমন সমালোচনার মুখে এরশাদকে পড়তে হয়নি। তাছাড়া ওইদিনের পর থেকেই এরশাদ-রওশনের মাঝে একটু রাগ-বিরাগ চলছিল।
পরে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যরা তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। তারা এরশাদকে বলেন, আপনি না থাকলে পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার মতো কোনো যোগ্য ব্যক্তি নেই। আপনিই একমাত্র যোগ্য। তাছাড়া আপনি পার্টির চেয়ারম্যান আছেন বলেই জাতীয় পার্টিকে এখনো মানুষজন ভোট দেয় এবং ভালোবাসে।
পাশাপাশি তার অনুপস্থিতিতে পার্টির হাল কেমন হবে তারও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন পার্টির মহাসচিবসহ অন্য নেতারা। এরপরই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন এরশাদ।
তবে এখন আর পার্টির নামেই চেয়ারম্যান থাকতে চান না, কাজেও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে চান এরশাদ। আর তাই সোমবার থেকেই নিয়মিত পার্টি অফিসে যাচ্ছেন তিনি। সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই পার্টি অফিসে আসছেন। আর এ সুযোগে অনেকেই তার সঙ্গে একান্তে দেখা করছেন কথা বলছেন। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন কমিটির ব্যাপারে ধর্ণাও দিচ্ছেন। কেউবা আবার ডিও লেটার ও বিভিন্ন কাজের জন্য তার কাছে আসছেন। তবে মিডিয়ার সামনে আসছেন না তিনি। বেশ চুপিসারেই অফিস করছেন।
নিয়মিত অফিসের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কার্যালয়ে আসেন এরশাদ। এদিন তার সঙ্গে প্রথমে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুজ্জামান নুরু, এসএম ফয়সাল চিশতী দেখা করেন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানাসহ অনেক নেতা। অবশ্য পরে সোহেল রানা সোয়া ১টার দিকে চলে যান এবং পার্টি মহাসচিবসহ এরশাদ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দুপুর ২টার দিকে তার বারিধারার বাসায় ফেরেন।
বুধবারও এরশাদ অফিস করেছেন কিন্তু এদিন তিনি ছিলেন অনেকটা বিষণ্ণ মনে। কেননা মঙ্গলবার রাতে পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যান কলকাতার একটি হাসপাতালে। পরে দুপুর আড়াইটার দিকে পার্টির মহাসচিবকে নিয়ে নাসিম ওসমানের গুলশানের বাসায় যান এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের লোকজনকে শান্ত্বনা দিয়ে তাদের খোঁজখবর নেন।
বৃহস্পতিবার মে দিবসে সন্ধ্যায় কাকরাইল কার্যালয়ে জাতীয় শ্রমিক পার্টির উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন এরশাদ। এসময় গুম-খুন নিয়ে সরকারের সমালোচনাও করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এদিকে হঠাৎ করেই পার্টির চেয়ারম্যানকে নিয়মিত অফিসে পেয়ে এরশাদপন্থিরা বেশ খুশী। তবে এরশাদের এমন কর্মকাণ্ডে অখুশী রওশনপন্থি নেতারা। এরশাদপন্থিরা বলাবলি করছেন, এরশাদ যে চেয়ারম্যান পদে যোগ্য এবং এখনো তার কর্মস্পিরিট রয়েছে তা জানান দিতেই নিয়মিত অফিস করবেন বলে তিনি অনেককে জানিয়েছেন।
আবার রওশনপন্থিরা বলছেন, এরশাদের মনের আকাশের মেঘের খেলা বুঝা বড় দায়। কেননা তার মনে কখনো রোদ আবার কখনো বৃষ্টিতে ভরপুর। তিনি তার কর্মকাণ্ডে কখনো আলোচনায় আসেন আবার কখনো সমালোচনার জন্ম দেন।
পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এরশাদ খুবই চালাক লোক। তার চেয়ারম্যান পদ রক্ষা করতেই তিনি হয়তো এমন চাল চালছেন।’
তবে পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘স্যারকে এখন থেকে নিয়মতিই পার্টি অফিসে পাওয়া যাবে। তিনি পার্টি অফিসে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, কেননা পার্টিকে চাঙা করতে চান তিনি।’
উল্লেখ্য, রোববার পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে এক যৌথসভা রাজধানীর গুলশান-১ এর স্পেকট্রা কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি তার স্ত্রী রওশন এরশাদসহ পার্টির বিভিন্ন নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েন। এ সময় তিনি সবার কথাই শোনেন কিন্তু কোনো ধরনের উত্তর দেননি।
সেদিন বিকেলে সভা শেষ হওয়ার পরই বিভিন্ন মিডিয়ায় ওই সভায় কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হয় সেই বিষয়গুলো ওঠে আসে। এতে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন এরশাদ। সেই রাতে পার্টির অনেক প্রেসিডিয়াম সদস্যদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গিয়েছিল।



মন্তব্য চালু নেই