এবারের বিশ্বকাপ ও মাশরাফি-ধোনীদের অর্জন

কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের ক্রিকেটমোদী-সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিলো কোনো মতে সম্মান রক্ষা হলেই তো অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতির সাথে সাথে ক্রিকেটমোদীদের সেই প্রত্যাশা আজ অনেক পাল্টে গেছে। এখন একটু ভালো খেলা নয়, যে কোনো ম্যাচে জেতার প্রত্যাশা’ এমনটাই লক্ষ্য করা গেছে এবারের বিশ্বকাপ থেকে।

বাংলাদেশ দল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সফলভাবে বিদায় নিয়েছে! অনেকে বলতে পারেন, বিদায় নিয়েছে আবার সফলভাবে কিভাবে। আসলে বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে খেলতে যায় তখন এর চেয়ে বেশি কে প্রত্যাশা করেছিলেন! ক্রিকেটের জনক-আবিষ্কারককে বিদায় করে টাইগাররা কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। গ্রুপ পর্বে ভালো খেলে দুটি ম্যাচ হেরেছে। নিউজিল্যন্ডের সঙ্গেতো জিততে জিততে হেরেছে টাইগাররা।

আর বাংলাদেশ-ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেও বাংলাদেশের প্রতি সারাবিশ্ব জুড়ে যে আবেগ সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো মাপকাঠিতেই পরিমাণ যোগ্য নয়।ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে বিশ্বে আর কখনও এতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এদিক বিবেচনায় কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশী।কেননা, কোয়ার্টার ফাইনালে জিতে বাংলাদেশ যে সুনাম অর্জন করতে পারতো, এই ম্যাচে হেরেও এর চেয়ে হাজার গুণ বেশী অর্জন হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ দলের সুনাম-সুখ্যাতি ও সমর্থক।

বিতর্কিত কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ দল ভারতের কাছে হারার পর বিশ্বের নামদামী ক্রিকেটারদেরও বাংলাদেশ দল ও তাদের খেলাকে যেভাবে প্রশংসা ও মূল্যায়ন করতে দেখা গেছে, তা ইতোপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি। ফলে এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন, আত্মশ্লাগার বিষয়।

আমার মতে, এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পেয়েছে অনেক কিছু। মাহমুদুল্লাকে নতুন করে পেয়েছে। শৌম্য সরকার, তাকসিন তাদের জাত চিনিয়েছেন। মাশরাফির অসাধারণ নেতৃত্ব। বড় দল হিসেবে পরিচয়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো সেঞ্চুরি ছিল না সেটা পূরণ হয়েছে। বিদেশি কোনো কোনো মিডিয়াকে বলতে শোনা গেছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ ইচ্ছে করে হেরেছে। ভারতের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল পড়বে তাই। যারা এতদিন বলেছেন বাংলদেশ জিততে জানে না তারাই বলছেন ইচ্ছে করে হারছে! এটাও এ বিশ্বকাপের একটা অর্জন।

এখন আসা যাক কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ হারেনি তাকে জোর করে হারানো হয়েছে। অনেককে বলতে শোনা গেছে বাংলাদেশ ১১ জনের বিপক্ষে খেলেনি, খেলেছে ভারতের ১৪ জনের বিপক্ষে। কেউ আবার বলছেন আইসিসির সহায়তায় বাংলাদেশকে হারালো ভারত। কেউ বলেছেন ভারত জিতেছে, হেরেছে ক্রিকেট। অনেক নামি খেলোয়াড়রাও এ ম্যাচে আম্পায়ার নিয়ে সমালোচনা করেছেন। অনেকে বলছেন, আহ কী ম্যাচ দেখলাম। রোহিত শর্মা আউট হলে হয় নো বল আর মাহমুদুল্লাহ ছয় মারলে হয় আউট!

ম্যাচ শেষে মাশরাফির জরিমানা নিয়েও সমালোচনা করেছে কেউ কেউ। তাঁরা বলেছেন, স্লো ওভার রেটের কারণে মাশরাফিকে জরিমানা করা হলো। স্লো ওভার কি মাশরাফি ইচ্ছে করে করেছেন? ভারতীয় ব্যাটসম্যানওতো দায়ী। রুবেলের বলে কয়েবার শেখর ধাওয়ানকে সরে যেতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তাকে তো আম্পায়ার সতর্ক করেনি বারবার সরে যাবার জন্য। এতে তো সময় বেশি লেগেছে।

অন্যদিকে অনেকে বলেছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারতের থাকা না থাকার ওপর আইসিসির লাভ-ক্ষতির অনেক কিছুই নির্ভর করে। প্রশ্ন উঠেছে, নিজেদের স্বার্থেই কি আইসিসি আম্পায়ারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে? ভারতের বিপক্ষে করা বাংলাদেশের রিভিউগুলো অনেক ক্লোজশর্টে দেখা হলেও বাংলাদেশের বেলায় তা একেবারেই উল্টো ছিলো! কেন? আম্পায়ারদের ওপর কি ওপরের ইশারা ছিলো যে ভারতকে রাখতেই হবে টুর্নামেন্টে? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে সে দিনটি লজ্জাতম দিন হিসেবেই আখ্যা দিতে শুরু করেছেন ক্রিকেটমোদী দুনিয়া। যা ঘটেছে তা আর কোনো দলের ক্ষেত্রেই যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার দাবি অবশ্যই আমলে নেয়া দরকার।

এটা সত্য যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অতীতে অনেকবার বাজে আম্পায়ারিঙের শিকার হয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো মেগা ইভেন্ট যেখানে ডু অর ডাই ম্যাচ সেখানে বাজে আম্পায়ারিং কোনো যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রযুক্তির এতো ব্যবহার সত্ত্বেও যখন বাজে আম্পায়ারিং হয় তখন স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় আইসিসির প্রভাবেই কি এমনটা হয়েছে? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, যে বাজে আম্পায়ারিঙের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ সে দায়ভার কার? আইসিসির নাকি আম্পায়ারদের? যদি আম্পায়ারদের হয়ে থাকে তাহলে আম্পায়াররা কি প্রাপ্য শাস্তি পাবেন? বিপরীতে আইসিসির ইশারায় যদি আম্পায়াররা বাজে রেফারিং করে তাহলে আইসিসির বিচার করবে কে?

এছাড়া বাংলদেশের কোনো আম্পায়ারের কি যোগ্যতা নেই বিশ্বকাপে আম্পায়ারি করার মতো। কোয়ার্টার ফাইনালে খেলছে বাংলাদেশ, কিন্তু ম্যাচে একজন ধারাভাষ্যকার নেই বাংলাদেশি! আতাহার আলী খানরা কি যোগ্য নন ধারাভাষ্য দেয়ার। কে বোঝাবে আইসিসিকে এসব।

অতীতে আমরা দেখেছি, বিশ্বকাপ বা যেকোনো ধরনের টুর্নামেন্ট হোক। ভারতের খেলায় বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের একটি বড় অংশ থাকতো ভারতের পক্ষে। কিন্তু এবার দেখা গেল ঠিক বিপরীত। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের হারের পর উল্লাস করেছে বাংলাদেশের সমস্ত সমর্থকরা। আমার বিবেচনায় যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে চিত্র নায়িকা জয়া আহসান ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী ভারতের সমর্থনে ছিলেন বলে আমার জানা নেই।

ফলে এই বিশ্বকাপে ভারত যেমনি তাদের ক্রিকেটের সুনাম-সুখ্যাতি হারিয়েছে তেমনি বিশ্বব্যাপী হারিয়েছে তাদের অগণিত সমর্থকও। সেই সাথে আইসিসিও নিজেদের সুখ্যাতি হারিয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, ক্রিকেট নিয়ে এই উপমহাদেশের জনগণের মধ্যে যে সৌহার্দ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানেও দেখা দিয়েছে এক বিরাট তিক্ততা। এক্ষেত্রে বলা যায়- গত কয়েকদিন থেকে ভার্চুয়াল জগতে এই বিশ্বকাপ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশীদের মধ্যে যে রেষারেশি লক্ষ্যণীয় তা ইতোপূর্বে আর কখনো দেখা যায়নি।





প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার বিশ্বকাপে অষ্ট্রেলিয়ার কাছে ভারতের হার নিশ্চিত হওয়ার কিছুক্ষণ পর নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাঙ্গালিদের উদ্দেশ্য করে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়ে ‘নতুন পাকিস্তান’ -এর অভ্যূদ্বয় ঘটেছে বলে নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেন ওপার বাংলার কণ্ঠশিল্পী বাংলা ব্যান্ড ফসিলসের জনপ্রিয় ভোকাল রূপম ইসলাম। রূপম ইসলাম তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বাংলাদেশিরা ছোটলোক, তারা মানুষ হয়ে উঠেনি।

রুপম বাংলাদেশিদের বাঙ্গালি বলতেও আপত্তি প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘সরি, এদেরকে যদি বাঙ্গালি বলি তবে আমি অস্থিত্ব সংকটে পড়ে যাবো।’এই শিল্পী বাংলাদেশিদের বাঙ্গালিত্বের চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ‘হয় আমি বাঙ্গালি, বুকের পাটাওয়ালা….হেরে গিয়ে একে ওকে দোষ দিয়ে প্যানপ্যানানি গাওয়া; না, সৌরভ গাঙ্গুলির মতো শতো অবিচার সহ্য করে নিয়ে মাঠে জবাব দেয়ার মতো বাঙ্গালি; অথবা এরা। এই ধরণের ছোটলুকামির কোনো দরকার ছিলো কি’?

কলকাতার এই শিল্পী বাংলাদেশেও মোটামুটি জনপ্রিয় ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে উদ্দেশ্য করে তার এই চরম বিষোদগারে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে। বাংলাদেশি তো বটেই, খোদ স্বদেশীয় বাঙ্গালিরাই তাকে তুলোধুনা করে ছাড়ছেন ভার্চুয়াল যুদ্ধে। ক্রিকেট নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের যে বৈরী সম্পর্কের শুরু হয়েছিলো ১৯ মার্চ তার গনগনে আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দিলেন এ গায়ক।

আমরা সবাই জানি, শিল্পকলা-সাহিত্য, চলচ্চিত্র-নাটক, সঙ্গীত-নৃত্য এসব যে কোনো জাতির সভ্যতা-সংস্কতির পরিচয় বহন করে। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এসব ক্ষেত্রে যে জাতি যতবেশী উন্নত তারা ততবেশী সভ্য জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে পরিচিত। এদিক থেকে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বাঙালী জাতির অন্যরকম সুনাম-সুখ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী।এক্ষেত্রে যাদের সবচেয়ে বড় অবদান তারা হলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ।কেননা, এসব অঙ্গনে যারা কাজ করেন তারা সমাজের মডেল। তারা প্রতিনিয়ত তাদের কর্ম ও ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সমাজকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেন । কেননা, এরা সমাজের পুরাতন কুসংস্কারকে ভেঙে নতুন সভ্যতার বিনির্মাণ করেন।এরাই সমাজের সুশীল ও বুদ্ধিজীবী। কিন্তু কোনো কারণে এরা কখনো বিবেকহীন আচরণ করলে গোটা জাতি বিপদগামী হয়। কিন্তু আজ দু:খ হয়, ওপার বাংলার কণ্ঠশিল্পী বাংলা ব্যান্ড ফসিলসের জনপ্রিয় ভোকাল রূপম ইসলামের লোকদের রুচিবোধ দেখে। মানুষ কতটা নীচু মনের অধিকারী হলে এমন মন্তব্য করতে পারেন!এটা তাদের (ভারতীয়) হীনমন্যতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই বিশ্বকাপে অনেক অর্জনের মধ্যেও যে আমরা একেবারে নির্ভুল ছিলাম তা বলা যাবে না। কেননা, চলমান বিশ্বকাপের সাম্প্রতিক কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ খেলা নিয়ে বিতর্কে অযথা যোগ দিয়েছেন আমাদের দেশের হর্তাকর্তারা। অনেকের মতে, এটা ভুল কূটনীতির একটি উদাহরণ।ওই খেলায় পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পরাজয় নিয়ে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছেন।ক্রিকেটের শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)কে তারা ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আখ্যা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক কর্তারাও বাদ যাননি। ফলে অনেকের মতে, এ ধরনের মন্তব্য অপ্রীতিকর এবং এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় ছিল।

সবশেষে আমরা বলবো, এই বিশ্বকাপ থেকে আমাদের অর্জন অনেক। অন্যদিকে এই বিশ্বকাপে সুদীর্ঘকালের গৌরবোজ্জ্বল ভারতের ক্রিকেটের ছন্দপতন ঘটেছে। তারা হারিয়েছে অনেক কিছু। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে বীরের মতো খেলেছে। এমনকি এবারের বিশ্বকাপ যাত্রায় তাদের সমালোচকদেরও আপন করে নিয়েছে। তাদের যাত্রা থেমেছে ভারতের হাতে। কিন্তু মাঠের ফলাফলকে মাঠের বাইরের অভিসন্ধির সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা কোনো মতেই উচিত নয়। তাই আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতি আহবান রাখবো- ক্রিকেট ম্যাচকে রাজনীতিকরণ করা থেকে দূরে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সময় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তবেই আশা করা যায়- আগামী দিনে আমাদের সোনার ছেলেরা আরো বীর দর্পে সামনে এগিয়ে যাবে এবং দেশের জন্য সুনাম-সুখ্যাতি বয়ে আনতে সক্ষম হবে।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক



মন্তব্য চালু নেই