সাভার ট্রাজেডি
এখনো মিলছে হাড়, এখনো লাশের গন্ধ
সাভারের রানা প্লাজার ওই স্থানে গিয়ে মনে হচ্ছিল এটি যেন কোনো বধ্যভূমি। আটতলা ভবন ধসে হাজারো মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনার দুটি বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো পড়ে আছে ইট-কংক্রিটের স্তূপ। মাঝখানে পানি জমে তৈরি হয়েছে ডোবা। ওই ডোবায় ১৯ এপ্রিল পাওয়া গেছে ছয়-সাতটি হাড়। কয়েক দিন আগের বৃষ্টিতে জমা পানি ধ্বংসস্তূপে আটকে বের হচ্ছে ভয়ানক দুর্গন্ধ। বৈশাখের উষ্ণ বাতাসে সেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিক।
গতকাল মঙ্গলবার ভরদুপুরে রানা প্লাজার ওই ঘটনাস্থলে গিয়ে এমন পরিবেশ দেখা যায়। সেখানে পাওয়া গেল গেল ফিরোজা বেগমকে। সঙ্গে আনোয়ারা বেগম। দুর্গন্ধ সয়ে বসে আছেন তাঁরা। ষাটোর্ধ্ব দুই বৃদ্ধা ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ভবন ধসে সন্তান হারিয়েছেন। ঘটনার ১৭ দিন পর ফিরোজা বেগম তাঁর ছোট ছেলে মো. রফিকের লাশ পেয়েছিলেন। আনোয়ারা বেগম পেয়েছিলেন মেয়ে শিউলী আক্তারের লাশ। ফিরোজা-আনোয়ারা দুজনই ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছিলেন।
কিন্তু চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের টানে বাড়িতে মন টেকে না। নাড়ির টানে বার বার চলে আসেন এই ধ্বংসস্তূপের কাছে। প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুই বেলা রানা সেখানে আসেন তাঁরা। সন্তানদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া করেন। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রায়ই মিলছে হাড়। সেগুলো জড়ো করে রেখেছেন মোমিনুল ইসলাম।
ফিরোজা বেগমের ভাষ্য, অন্য ছেলেরা এখন তাঁর খোঁজ-খবর নেন না। স্বামী আব্দুল মান্নান বৃদ্ধ বয়সে দুজনের সংসারের হাল ধরেছেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কাঁচামরিচের ব্যবসা করেন তিনি।
ফিরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজান রফিকের ট্যাকাতেই বাঁইচ্চা আছি। কিন্তু আমার তিন ছেলে কোন খবর লয় না। রফিকের বাপে সকাল সকাল ঢাকায় চইলা যায়। আমি তাই এইখানে (রানা প্লাজা) সকালে একবার আসি, আবার আসরের আজানের সময় আসি।’
ফিরোজা বেগমের ভাষ্য, রফিকের লাশের সঙ্গে পরিচয়পত্র ছিল না। এ জন্য সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাখা লাশের সারি থেকে ছেলেকে শনাক্ত করতে হয়েছিল। এর পর সরকার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা পান। সেই টাকা ডাচ-বাংলা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখেছেন।
ফিরোজা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘মরা পোলার ট্যাকায় পেট চলে। জেতা পোলারা কেউ খবর লয় না।’
ফিরোজা বেগমের প্রতিদিনের সঙ্গী আনোয়ারা বেগম আসেন সাভারের ইমান্দিপুরের বাসা থেকে। মেয়ে শিউলীর স্বামী চিনু মিয়া আবার বিয়ে করায় দুই ছেলেমেয়ে শিমু (৮) ও শিমুল (৬) আনোয়ারার সঙ্গেই থাকেন।
আনোয়ারা বেগমও সহায়তা হিসেবে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছেন। এর অর্ধেক নিয়েছেন শিউলীর স্বামী চিনু মিয়া। চিনু মিয়াকে আনোয়ারা বেগমই আবার বিয়ে করিয়েছেন বলে জানান। বিয়ের পর শিউলীর ছেলেমেয়েকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন তিনি।
আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী এখন পঙ্গু। অহন স্বামীরে দেখমু না শিউলীর পোলপানেও দেখমু? তয় কষ্ট চইলা যায় এই রানা প্লাজায় আইলে। মনে হয় শিউলী আমার লগেই আছে।’
একদা সরগরম রানা প্লাজা এখন যেন এক বধ্যভূমি।তবে রানা প্লাজার অবস্থান যেখানে, সেই বিশাল জায়গা জুড়ে দুর্গন্ধ। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়ল একটুকরো মানুষের হাড়। সেই হাড় তুলে দিলেন মোমিনুল ইসলাম নামের ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। তাঁর ভাষ্য, কয়েক দিন আগেএখানকার ডোবার ভেতর থেকে দুটি হাড় পেয়েছিলেন। আরও কয়েকজন এমন হাড় পেয়েছেন। সবই পায়ের হাড়। হাড়গুলো জড়ো করে রাখা হয়েছে।
মোমিনুল বলেন, ‘আমার বউ সারভানুকে রানা প্লাজায় কাম করত ছয়তলায় ইয়ার টেক্স গার্মেন্টেসে। মাথায় পিলার পইড়্যা আহত হয় সে। এর পর অহন প্রায় পঙ্গু। আমি ওরে পাইছিলাম ১৭ এপ্রিল। এর আগে তিন দিন সারভানুকে খুঁজছিলাম। তাই আমি জানি অহনও এইখানে ইট সরাইলে লাশ পাওন যাইব।’
মন্তব্য চালু নেই