আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি'র প্রতিবেদন :

‘একটি নির্বাচনই পারে চলমান সংকট সমাধান করতে’

একটি নির্বাচনই পারে সরকারবিরোধী চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে। এ ছাড়া চলমান সহিংসতা বাংলাদেশের নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ক্রিস্টিয়ান ওট্টোনের লেখা ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ১২ বছরের শিশু রাকিব মিয়া তার পরিবারের জন্য দুমুঠো অন্নসংস্থানের লক্যেিশ বাসে চড়েছিল। বাসে দুর্বৃত্তের ছুড়ে মারা পেট্রলবোমায় জীবন্ত দগ্ধ হয় সে। ঢাকায় একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার চিকিৎসা চলছে।

প্রতিবেদনে লেখা হয়, “বিলাপ করে রাকিবের মা রাশিদা খাতুন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘আমার ছেলে কার কী ক্ষতি করেছে?’ ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে হুইল চেয়ারে করে মায়ের সামনে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি বলছিলেন, ‘সে আমাদের পরিবারের একমাত্র খাদ্য জোগানকারী সদস্য। আমরা আমাদের হাত দিয়ে শুধু জীবিকা অর্জন করতে পারি। কিন্তু, সে এখন সেটাও করতে পারবে না।’ সরকার ও বিরোধী দলের সহিংসতায় ঢাকার হাসপাতালে আহতদের উপচেপড়া ভিড়।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার শত্রুতা বহু যুগ পুরনো এবং তাদের দলীয় সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু, পর্যবেক্ষরা আশঙ্কা করছেন সাম্প্রতিক রক্তপাতের ঘটনা ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হতে পারে। এ বছর এ ঘটনাগুলোতে এখন পর্যন্ত ৮০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার সূত্রপাত। প্রধানমন্ত্রীর অনড় অবস্থান ও দলীয় কার্যালয়ে খালেদা জিয়া আটক থাকায়, আশার খুব বেশি আলো দেখছেন না কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ঢাকার একজন বিশ্লেষক আতাউর রহমান বলছিলেন, এ সহিংসতা চলতেই থাকবে এবং তা ধীরে ধীরে জ্বলবে। ২০১৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত স্থিতিশীলতা অধরাই থেকে যাবে। আতাউর রহমান বলেন, সহিংসতার দায়ের একটি অংশ অবশ্যই খালেদা জিয়াকে নিতে হবে। কিন্তু, তিনি এখনো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। ধারণা থেকে আতাউর রহমান এমনটাও বলছেন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির মতো গৃহবন্দিত্বেও কাটাতে পারেন বিরোধী দলের নেত্রী।

খালেদা জিয়া বলছেন, গত ৩ জানুয়ারি থেকে তিনি গুলশান কার্যালয় থেকে বের হতে পারছেন না। ‘প্রহসনমূলক’ নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকীতে বিক্ষোভ-আন্দোলনের আহ্বান জানানোর সময় থেকেই তিনি কার্যালয়ে আটক রয়েছেন। নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়া সড়ক-অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন। তারপর থেকে শত শত যানবাহন পেট্রলবোমার আগুনে পুড়েছে। বিরোধী দলের জঙ্গিরা এসব হামলা চালাচ্ছে বলে সরকারের অভিযোগ। অন্যদিকে, বিএনপি এর দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর।

বিরোধী দলীয় বহু কর্মীকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বহু দিক থেকে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাপ্রবাহ বেশি আতঙ্কজনক। কারণ, এ ঘটনাগুলো ঘটছে বিশৃঙ্খলভাবে এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে সহিংসতা অবসানের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের সার্জন সাজ্জাদ খন্দকার (৫৫) বলছিলেন, ককটেল বা বিশেষ হাতবোমা ও পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৫৫ জনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

১০০ শয্যাবিশিষ্ট বার্ন ইউনিটের করিডোরে চিকিৎসার অপেক্ষায় স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন বহু মানুষ। বেশির ভাগ মানুষই বলছেন কীভাবে তাদের যানবাহনে আগুন দেয়া হলো। ৫ ডলারেরও কমে এ হামলাগুলো চালাচ্ছে তরুণরা। গাজীপুরের একটি সবজির বাজার থেকে রাস্তায় পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট সবজি সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে ভয়াবহ হামলার শিকার হয় রাকিব। তার সারা শরীর আগুনে দগ্ধ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে আহতদের দেখতে গিয়ে বার্ন ইউনিটে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে চান কি না। প্রত্যুত্তরে তিনি ক্ষুব্ধভাবে বলেছিলেন, খুনিদের সঙ্গে, যারা আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, তাদের সঙ্গে? এমন কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, সরকার সংলাপের নীতির বিরুদ্ধে নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়। এএফপি’কে ইনু বলেন, আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ধর্মীয় জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ করা। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে উদ্দেশ্য করে তিনি এ মন্তব্য করেন।

গত সপ্তাহে এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া হাসিনাকে সরে দাঁড়ানো ও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সব দলের ঐকমত্যে ও আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই নির্বাচন হওয়া উচিত। পাল্টা-জবাবে ইনু বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে ঐক্যের সরকারে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু, সেটা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

খালেদা জিয়ার বয়কটকে মারাত্মক ভুল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, জনমত জরিপগুলো বিএনপির জয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ইউরোপীয় এক কূটনীতিক বলছিলেন, ব্যাপক পর্যবেক্ষণের আওতায় নির্বাচন হতো এবং ভোটে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত হলে, খালেদা জিয়া ব্যাপক কূটনৈতিক সমর্থন পেতেন। ওই কূটনীতিক বলেন, ঢাকায় জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। দেশকে অচল করে দিতে বিএনপির প্রচেষ্টা এখন তেমন একটা প্রভাব ফেলছে না। অপর এক পশ্চিমা কূটনীতিক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছিলেন, খালেদা জিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলায়, চলমান সহিংসতাই ‘নতুন স্বাভাবিক’ অবস্থা হয়ে হয়ে ওঠার মতো ঝুঁকি রয়েছে। অর্থাৎ, নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় এ সহিংসতাই হয়ে উঠতে পারে স্বাভাবিক।

তিন দশক ধরে পারস্পরিক অপছন্দের সম্পর্কের কারণে দুই নেত্রীকে ‘ব্যাটলিং বেগমস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শেখ হাসিনার পিতা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার স্বামী সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের নায়ক। দুই জনই হত্যাকান্ডের শিকার হন, যা তাদের শহীদী মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মও দুই নেত্রীর শত্রুতার বিষে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার পুত্র ও তার সুস্পষ্ট উত্তরাধিকারী তারেক রহমান সরকারকে ভীষণভাবে অপছন্দ করেন। তিনি এখন লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ২০০৪ সালে বোমা হামলার ঘটনায় অনুপস্থিতিতে তারেকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বিএনপির মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা করেন যে সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। খালেদা জিয়া ও অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ এনে তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখার ষড়যন্ত্র করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

১৯৭১ সাল থেকে প্রায় ২০টি অভ্যুত্থানের ঘটনার সাক্ষী বাংলাদেশ। তবে, পুনরায় সেনা হস্তক্ষেপ হতে পারে এমন রিপোর্ট নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, দ্রুত সঙ্কট সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংঘাত চলতে থাকবে।



মন্তব্য চালু নেই