একজন সম্রাজ্ঞী ও কিংবদন্তি সুন্দরী

মিসর সম্রাজ্ঞী, যিনি শ্বেতাঙ্গিনী হয়েও ছিলেন প্রাচ্যের প্রতিনিধি, যাঁকে আবার শিকার হতে হয়েছিল প্রাচ্যবাদেরও। এমনই এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ক্লিওপেট্রা। কে এই ক্লিওপেট্রা? এক রহস্যাবৃতা, অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, চিরন্তন মোহিনী? যেমনই হন ক্লিওপেট্রা, দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দশম শতাব্দীর এই রানীকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষের কৌতূহল বিন্দুমাত্র কমেনি বরং বেড়েছে। তাঁর নাম ও কল্পিত রূপ সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে একদিকে যেমন প্রসাধন ও অলঙ্কার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছে তাদের জমজমাট ব্যবসা, আরেক দিকে তাঁকে নিয়ে নাক সিঁটকেছে একশ্রেণীর অজ্ঞ ও শূন্যগর্ভ লোক। আবার কখনও হয়েছেন কালজয়ী সব চলচ্চিত্র অথবা নাটকের উপজীব্য বিষয়। কিন্তু এর সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে তাঁর প্রতি মানুষের মুগ্ধতা ও ভালোবাসা। তাঁকে নিয়ে আপল্গুত হয়েছেন বিশ্বে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মনীষী, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা। এখন পর্যন্ত ক্লিওপেট্রার প্রায় এগারোটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

১৯৩০ সালে ভ্যাটিকান একটি নাক মেরামত করা, হলদে হয়ে যাওয়া মার্বেলের এক মাথাকে সপ্তম ক্লিওপেট্রা বলে ঘোষণা করে। এর আগ পর্যন্ত ক্লিওপেট্রার শাসনকালের পনেরোটি বা ততোধিক কিছু মুদ্রা ছাড়া আর বিশেষ কিছু প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই মুদ্রাগুলোর কোনোটিতে তিনি একা, কোনোটিতে শিশু সিজারিয়নকে কোলে নিয়ে, আবার কোনোটায় তাকে দেখা যায় মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে। কিন্তু আর্শ্চযের বিষয় হচ্ছে, এযাবৎ প্রাপ্ত এই মুদ্রা বা মূর্তির কোনোটিতেই তাঁর বিস্ময়কর সৌন্দর্যের প্রমাণ মেলে না। এগুলোতে আমরা পাই টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক, আন্দাজ পাঁচ ফুট, একটু স্থূলাঙ্গী এক নারীকে যিনি আর যাই হোক সুন্দরী নন। তবে কি পল্গুর্টাকের কথাই ঠিক যে, শুধু শারীরিক সৌন্দর্যে নয়, ক্লিওপেট্রা অসাধারণ ছিলেন ব্যক্তিত্বে ও মোহিনী শক্তিতেও। মিসরের ঐতিহাসিকরা বলেন_ ক্লিওপেট্রা চিকিৎসাশাস্ত্র, অ্যালকেমি প্রভৃতির ওপর বই লিখেছিলেন এবং জনদরদিও ছিলেন। পল্গুর্টাক বলেছেন, মিসরের এই রানী ছিলেন সুকণ্ঠী এবং খুব সহজেই হিব্রু, আরবি, সিরিয়ান, ইথিওপিয়ান প্রভৃতি কম করে আট-নয়টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। দশম শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল-মাসুদি ক্লিওপেট্রার বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ ও জ্ঞানের কথাও জানিয়েছেন।

অন্যদিকে আমরা পাই ক্লিওপেট্রার সমসাময়িক সিসোরোর মন্তব্য :’আমি ক্লিওপেট্রাকে ঘৃণা করি’। কেন এই মেরুকরণ? তবে আসলে কেমন ছিলেন ক্লিওপেট্রা? সত্যি বলতে কি, ক্লিওপেট্রার এই বহুকৌণিক রূপের পেছনে দুটি ঘটনা কাজ করেছে, এক হ’ল তাঁর সচেতন প্রচেষ্টায় নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মনের মতো করে সাজিয়ে নিজেকে এক প্রবাদপ্রতিমায় পরিণত করা, যার মাধ্যমে ভাবীকাল ও স্বপ্নবিলাসী সাধারণ মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অভিনেত্রী ক্লিওপেট্রা। অন্যদিকে রোমান রাজনীতির জটিল আবর্ত যা আমাদের উপহার দেয় মোহিনী এক ক্লিওপেট্রাকে। সপ্তম ক্লিওপেট্রা ছিলেন মিসরের রাজা দ্বাদশ টলেমির বা টলেমি অলেটাসের তৃতীয় সন্তান। মিসরের টলেমিরা ছিলেন আলেকজান্ডারের ম্যাসিডনীয় এক সেনাপতির বংশধর। উত্তরাধিকার সূত্রে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের অনেকটাই এঁরা পেয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ‘৬৯ সালে। তিনি তাঁর ভাই ত্রয়োদশ টলেমির সঙ্গে যৌথভাবে রাজত্ব পান মাত্র সতের বছর বয়সে। এই সময় তাঁরা অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। আর এই সমস্যার সমাধানে ক্লিওপেট্রাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন জুলিয়াস সিজার। সিজারের সাথে এক যুদ্ধে নিহত হন ত্রয়োদশ টলেমি। এর মধ্য দিয়ে ক্লিওপেট্রা পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর আরেক ভাই চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্লিওপেট্রার সাথে সিজারের ঘনিষ্ঠতা শুরু।

খ্রিস্টপূর্ব ‘৪৭ সালে তাঁদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। জন্মের সময় ক্লিওপেট্রা তাঁর নাম রাখেন টলেমি সিজার। খুব শিগগিরই ক্লিওপেট্রার এই সন্তান পরিচিতি পায় ‘সিজারিয়ন’ নামে। যার অর্থ ‘ছোট সিজার’ (সিজারিয়ন অর্থ ‘সিজার থেকে’। কথিত আছে, সিজারকে তার মায়ের দেহ থেকে কেটে আলাদা করা হয়, সেই থেকে সিজার শব্দটি চিকিৎসাশাস্ত্রের সাথে জুড়ে বসে।) খ্রিস্টপূর্ব ৪১ সাল নাগাদ ক্লিওপেট্রার সাথে সাক্ষাৎ হয় মার্ক-অ্যান্টনির। অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার অমোঘ আকর্ষণের কাছে পরাজিত হয়ে স্ত্রী অক্টেভিয়াকে (অক্টেভিয়াস সিজারের বোন) পরিত্যাগ করে চলে আসেন ক্লিওপেট্রার কাছে। তাঁদের এই মিলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় দুই যমজ সন্তান_ একটি কন্যাসন্তান ক্লিওপেট্রা সিলিন ও আরেকটি পুত্রসন্তান আলেকজান্ডার হিলিওস এবং পরে টলেমি ফিলাডেলপস। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৩১ সালে অক্টেভিয়াসের কাছে ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির মিলিত সেনা গ্রিসের অ্যাক্টিয়ামে নিদারুণভাবে পরাজিত হন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০-এ ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনি দু’জনেই আত্মহত্যা করেন। নিজের মৃত্যুর মাধ্যমেও ক্লিওপেট্রা এক চরম ট্র্যাজেডির অবতারণা করেন। যা তাঁকে করে তোলে আরও মোহময়ী। মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রার বহু স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস হয় অক্টেভিয়াসের হাতে। টলেমি বা ক্লিওপেট্রার আসল রাজধানী ৩৩৫ শতাব্দীর বন্যা ও ভূমিকম্পে জলের তলায় চলে যায়।

১৯৯৬ সালে আলেকজান্দ্রিয়ার পূর্ব বন্দরে জলের তলায় ডুবুরি পাঠিয়ে পাওয়া যায় ক্লিওপেট্রার রাজপ্রাসাদের মার্বেলের মেঝে ও ভাঙা স্তম্ভ। ১৯৯৮ সালে এখানেই আবিষ্কৃত হয় দেবী আইসিসের এক পূজারীর মূর্তি, ক্লিওপেট্রার বাবার মুখের আদলে গড়া একটি স্টিম্ফংস এবং খুব সম্ভবত সেই বজরা যাতে করে ক্লিওপেট্রা প্রথম অ্যান্টনির সামনে আসেন। সম্প্রতি আলেকজান্দ্রিয়ার কাছাকাছি তাপসিরিস ম্যাগনা মন্দিরে টলেমিক শাসন আমলের বেশকিছু প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করছেন, হয়তো এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্টনির সমাধি ক্ষেত্র। আর তা যদি আবিষ্কৃত হয়, তাহলে তা হবে ১৯২০ সালে তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পরে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্তি্বক আবিষ্কার। প্রত্নতত্ত্ববিদদের আশা, এভাবেই হয়তো আরও অনেক কিছুই আবিষ্কার হবে যাতে করে ক্লিওপেট্রাকে জানা আমাদের পক্ষে আরও সহজ হবে।

বর্তমান সময়ের পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাও অনুভব করছেন অবিচার করা হয়েছে ক্লিওপেট্রার প্রতি। আসলে কেমন আচরণ করা হয়েছে ক্লিওপেট্রার প্রতি? চলুন জানা যাক ইতিহাস কী বলে? মিসর সম্রাজ্ঞীর প্রতি সাধারণভাবে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তিনি এক ক্ষমতালিপ্সু রানী, তাঁর যৌনজীবন অতিরিক্ত উচ্ছৃঙ্খল, তাঁর শরীরী আবেদনের কাছে একবার নয়, দু-দুবার পদানত হয়েছেন পরম পরাক্রান্ত দুই রোমান সেনাধ্যক্ষ জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনি। সে আমলের গ্রিস ও রোম ছিল চরম পুরুষতান্ত্রিক। যদিও ক্লিওপেট্রা ছিলেন টলেমি বংশজাতা তারপরও তিনি ছিলেন প্রাচ্য দেশের একজন নারী শাসক যার আবার দু’জন প্রতিপত্তিশালী রোমানের সঙ্গে প্রণয়_ তিনি তো রোমান পিতৃতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও প্রাচ্যবাদের বিষ নজরে পড়বেনই। সে সময়ে রোমে মার্ক অ্যান্টনির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন জুলিয়াস সিজারের দত্তক পুত্র অক্টেভিয়াস সিজার। এই অক্টেভিয়াসের বোন ছিলেন অ্যান্টনির প্রথম স্ত্রী অক্টেভিয়া যাকে ত্যাগ করে অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রার কাছে চলে গিয়েছিলেন। অক্টেভিয়াস দেখলেন সুবর্ণ সুযোগ! ক্লিওপেট্রাকে যৌনতার প্রতীক, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারিণী এক নারী শাসক রূপে প্রতিষ্ঠা করে অ্যান্টনিকেও ঘায়েল করতে চাইলেন তিনি। কারণ তখন অ্যান্টনির পরিচয় দাঁড়াল তিনি এমন একজন রোমান যিনি প্রাচ্যের এক বহুবল্লভ নারীর কাছে নিজের পৌরুষ বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু অক্টেভিয়াস সম্ভবত বুঝতে পারেননি কখন যে তিনি নিজের অজ্ঞাতসারেই তাঁর নির্মিত বৈভবের দেশে রানীকে দিয়ে ফেলেছেন এক পরম কাঙ্ক্ষিতা নারীর ভাবমূর্তি।

প্রাচ্য যুগে যুগে অমোঘভাবে আকর্ষণ করেছে সাদা পুরুষকে, তাই রানী হয়ে ওঠেন আরও বেশি আকর্ষণীয় ও আদিম মোহনীয়। এ তো গেল রোমান রাজনীতির কথা। কিন্তু ক্লিওপেট্রাও যে অত্যন্ত সুকৌশলে ও সুচিন্তিতভাবে নিজের হাতে নিজের জীবনকে গড়তেন এবং মনের মতো রঙে রাঙিয়ে নিতে চাইতেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে, তা কিন্তু বেশকিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। তিনি সবসময় প্রজাদের সামনে দেবী আইসিসের রূপসজ্জায় আবির্ভূত হতেন। কিডন্স নদীতে সুপরিকল্পিত ও নাটকীয়ভাবে অ্যান্টনির সামনে নিজেকে দেখা দেওয়া আর অসাধারণ সাহসের সাথে মৃত্যুবরণ করা, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে দেবী আইসিসের পার্থিব রূপ হিসেবেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন।

ক্লিওপেট্রাকে সবসময় দুটি ভূমিকায় দেখা যেত_ একদিকে দেবী আইসিসের রূপে, আরেক দিকে প্রাণচঞ্চল, আড়ম্বরপ্রিয় রানীর ভূমিকায়। ক্লিওপেট্রা সম্পর্কে অনেক কাহিনীই আজ কিংবদন্তির রূপ ধারণ করেছে। এমনই একটি হ’ল অ্যান্টনির সাথে বাজি ধরে ক্লিওপেট্রা শুধুুমাত্র একটি নৈশভোজেই ব্যয় করেছিলেন ১০,০০০,০০ সেস্টার্স। এই ভোজে রানী আরেকটি মজার কাণ্ড করেন, তিনি তাঁর কানের গহনা থেকে এক অমূল্য মুক্তো খুলে ভিনেগারে ডুবিয়ে দেন এবং তা গলে গেলে সেই ভিনেগার পান করেন। শুধু তাই নয়, শোনা যায়, রানী একবার সিজারকে এক অতুলনীয় ভোজে আপ্যায়ন করেন, যেখানে সারা পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করা সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করা হয় সোনার পাত্রে। এভাবেই ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন বিলাস ও প্রাচুর্যের প্রতীক। ক্লিওপেট্রা মনে হয় জানতেন যে, একমাত্র ্তুরহভরহরঃব াধৎরঃু্থ বা অসীম বৈচিত্র্যই তাঁর প্রতি অ্যান্টনির আগ্রহকে জিইয়ে রাখতে পারবে। তাই তো তিনি অতি সুচিন্তিত সাজসজ্জা ও নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে অ্যান্টনির সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতেন।

রোমান এই সেনানায়কের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় ক্লিওপেট্রার কিডন্স নদীর ওপর বজরায় আবির্ভূত হবার সেই আশ্চর্যজনক দৃশ্যটিও ছিল সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। রানী স্বয়ং ছিলেন দেবী আইসিসের পোশাকে আর তাঁর সঙ্গিনীরা ছিলেন দেবীর সহচারী সমুদ্র-ললনারূপে। এরও আগে জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারের ঘটনাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। ত্রয়োদশ টলেমি ও ক্লিওপেট্রার মাঝে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল সিজার তখন মিসরে বেড়াতে এসে কিছুদিনের জন্য বাস করেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে। রানী তখন তাঁর কিছু অনুগতদের সাহায্যে নিজেকে একটি কার্পেটের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন। গোটানো সেই কার্পেট খুলে দিতেই সিজারকে চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্লিওপেট্রা। এমন অপূর্ব রোমাঞ্চকর সমুত্থানের কথা আমরা এর আগে কোথায় শুনেছি? তাঁর হাস্যরস ও কৌতুকপ্রিয়তা নিয়েও আছে অনেক লোকপ্রিয় গল্প।

একবার মাছ ধরতে গিয়ে বিফল অ্যান্টনি জেলেকে শিখিয়ে রাখলেন পরেরবার তাঁর ছিপে জ্যান্ত মাছ গেঁথে দিতে। ক্লিওপেট্রা ব্যাপারটা জানতে পেরে গোপনে জেলেকে নির্দেশ দিলেন অ্যান্টনির ছিপে নুন জড়ানো মাছ গেঁথে রাখতে। পরের দিন ছিপে মাছ পড়েছে ভেবে উৎফুল্ল অ্যান্টনি ছিপ তুলতেই পেলেন শুকনো মাছ! ওদিকে রানী হেসেই খুন। এভাবেই আমুদে স্বভাব ও বিলাসিতা দিয়ে ক্লিওপেট্রা তাঁর প্রতি অ্যান্টনির আকর্ষণ ধরে রাখতেন। কেবল অ্যান্টনির সামনেই নয়, প্রজা সাধারণের সামনেও রানী সর্বদা আসতেন তাদের উপাস্য দেবী আইসিস রূপে। কে এই দেবী আইসিস? খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিক থেকে আফ্রিকা, মিসর, ইথিওপিয়ায় শুরু হয় দেবী আইসিসের আরাধনা। আকাশ ও ধরণীর সন্তান আইসিস এবং ওসিরিস ছিলেন জন্মের পূর্ব হতেই প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ। পরে তাঁদের আরেক ভাই টাইফন বা সেট ওসিরিসকে হত্যা করে তাঁর শরীর খণ্ড খণ্ড করে ফেলেন। কিন্তু আইসিস ওসিরিসকে পুনর্জীবন ও অমরত্ব দান করেন। ক্লিওপেট্রা জানতেন জনমানসে প্রয়োজনীয় অভিঘাত ও মুগ্ধতা সৃষ্টি করতে হলে তাঁকে হাজির হতে হবে অপার্থিবরূপে। এই ব্যাপারটা তখনকার রাজ-রাজাদের মধ্যে খুব যে বিরল ছিল তাও কিন্তু নয়। অন্যদিকে মার্ক-অ্যান্টনি প্রচার করতে ভালোবাসতেন যে তিনি দেবতা ডায়োনিসিসের পার্থিব রূপ। প্রজারাও তাঁকে এই বলে জয়ধ্বনি দিত। আর অনেক সময়ই ডায়োনিসাস ও ওসিরিসকে একত্ম করে দেখা হতো। দু’জনেই ছিলেন উভলিঙ্গ, দুুই দেবতাই অনেক সময় মেয়েদের মতো লম্বা পোশাক পরতেন। দুই দেবতাকেই তাঁদের শত্রুরা_ যথাক্রমে সেট ও টাইটানরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন। একজনকে দেবী আইসিস, অন্যজনকে দেবী বিমিটর পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন। ডায়োনিসাস ছিলেন সুরা, বাহুল্য ও ইন্দ্রিয়সুখের দেবতা। ইংরেজিতে ফরড়হুংরধপ শব্দটিও আড়ম্বর ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকেই বোঝায়। শোনা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩২ অব্দের যুদ্ধের অল্পকাল আগে ক্লিওপেট্রা অ্যান্টনিকে সঙ্গে নিয়ে সামোস দ্বীপে গিয়ে অনন্যপূর্ব জাঁকজমকের সাথে উৎসব পালন করেন যাতে তাঁর এই বৈভব দেখে শত্রুদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এমনকি অক্টিয়ামের সেই হারের পরেও ক্লিওপেট্রা তার অনুগতদের মনোবল ও সাহস বাড়াবার জন্য এরকমই এক আড়ম্বরপূর্ণ ঋদ্ধ উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। এভাবেই যেন তাঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, অ্যান্টনিই হচ্ছেন ওসিরিস বা ডায়োনিসাস এবং ক্লিওপেট্রা দেবী আইসিসের পার্থিব রূপ। এটিও যে একজন বাস্তববাদী রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক চাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

‘আস্প’ নামক ছোট সাপ নিয়ে আত্মহননের মুহূর্তেও আমরা সেই একই অভিনেত্রী ক্লিওপেট্রাকে ফিরে পাই। ক্লিওপেট্রার এই শাসরুদ্ধকর আত্মহত্যা যেন প্রমাণ করল, তিনি তাঁর স্বামী ও প্রেমিক ওসিরিসের সাথে মিলিত হতে চলেছেন। ক্লিওপেট্রা তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রেমকে কালোত্তীর্ণ বা কালজয়ী করে গিয়েছেন। আর নিজের অবিনশ্বরতাকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহার করেছেন দেবতা ওসিরিসের মৃত্যুহীনতা। এই ক্লিওপেট্রার মধ্যেই একদিকে দেবী আইসিস, অন্যদিকে এক প্রাণোচ্ছল দ্যুতিময়ী মোহনীর অদ্ভুত সমন্বয়। আর এতেই প্রথিত আছে তাঁর সাতরঙা ব্যক্তিত্বের রহস্য। তাঁর মৃত্যুর দুই সহস্রাব্দ পরেও তিনি আজও আমাদের কাছে এক আলো-আঁধারের মানবী হিসেবে ধরা দেন। ক্লিওপেট্রা মানেই প্রেম, ক্লিওপেট্রা মানে দুর্ধর্ষ অন্তর্দৃষ্টি ও সাহসের সাথে নিজের জীবনকে নিজ হাতে সাজিয়ে নেওয়া। তিনি তছনছ করে দিয়েছিলেন আদিম ও আবহমান পুরুষতন্ত্রের সমস্ত পূর্বনির্ধারিত ছক, দিয়েছিলেন নির্মিতির শিকড় ধরে টান। তাই তো তাঁর সামনে দাঁড়ালে একদিকে যেমন অদম্য আকর্ষণ বোধ করে পরাজিত পুরুষ, তেমনিই ভয়ে কেঁপে ওঠে তাদের পাংশু হৃদয়।

লেখক: কলামিস্ট, সাহিত্যিক



মন্তব্য চালু নেই