এই শীতে ঘুরে আসুন হ্রদ, পাহাড়, ঝর্ণার রাঙামাটি

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি : আমাদের দেশে ভ্রমণকারীগন সাধারনত শীতে বেড়াতেই বেশী পছন্দ করেন। অবশ্য এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। আপনিও যদি তেমনই একজন ভ্রমনকারীর মত হয়ে থাকেন,তাহলে নিশ্চয়ই এবারের শীতে কোথাও বেড়াতে যাবার কথা ভাবছেন ? কোথায় যাবেন …..? সৈকত না পাহাড় ? নাকি অরণ্যভূমি সুন্দরবন ? যদি পাহাড়কে বেছে নেন, তাহলে নিশ্চিন্তে চলুন রাঙামাটি। কান পেতে শুনুন-হ্রদ পাহাড়ের শহর আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যেখানে রয়েছে হ্রদ-পাহাড় পর্বত, ঝর্ণা,সংষ্কৃতি ও প্রকৃতির কত সাদৃশ্য।

দর্শনীয় স্থান সমূহঃ-

সুবলং ঝরনাঃ রাঙামাটির অন্যতম সুন্দর দর্শনীয় স্থান এটি। চমৎকার একটি জলপ্রপাত এই স্থানকে দিয়েছে ভিন্ন একটি চরিত্র। রাঙামাটি শহর থেকে ২০-২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মনোরম এই ঝরনাটি। এ ঝর্নার রূপ আপনাকে মোটেও আশাবিরূপ করবে না।ঝর্নাস্নান কিংবা দর্শন শেষে আপনি সামনে এগিয়ে গেলে পাবেন সুবলং বাজার। হ্রদের তীরে অবস্থিত স্থানীয় এই বাজারে রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প। বাজারটি একেবারে ছোট নয়। এখানকার খাবার বেশ সুস্বাদু। দুপুরের খাবারটি চাইলে সেখানে সেরে নিতে পারবেন।

চাকমা রাজবাড়িঃ রাঙামাটি শহরেই অবস্থিত চাকমা রাজবাড়ি। চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও তার মা রানী আরতি রায় এ রাজবাড়িতে থাকেন বর্তমানে। চারদিকে হ্রদে পূর্ণ এই রাজবাড়ি পুরনো হলেও দেখতে ও বেড়াতে ভীষন ভালোই লাগবে। রাজবাড়ীর পাশেই উপজাতীয় নারীরা তাদের হাতে বুনা বস্ত্র সম্ভার নিয়ে বসে থাকে বিকিকিনির জন্য। এসব পন্য আপনার প্রয়োজনের পাশাপাশি মেটাবে রুচির তৃষ্ণা।

রাজবন বিহারঃ রাজবাড়ির পাশেই আন্তর্জাতিক খ্যাত সম্পন্ন এই বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। এখানে অবস্থান করেছিলেন বৌদ্ধ আর্য পুরুষ শ্রাবক বুদ্ধু সর্বজন পূজ্য শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তে। এই বৌদ্ধ বিহারে প্রত্যেক বছরের কঠিন চীবর দানোৎসবে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। এছাড়া প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনাথী ও পুণ্যানর্থীর ভিড়ে মুখরিত থাকে রাজবন বিহার। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির, বিশ্রামগার, হাসপাতাল ও বটবৃক্ষ সহ অনেক কিছু রয়েছে দেখার মত সেখানে।

ঝুলন্ত ব্রীজ ও পর্যটন মোটেলঃ রাঙামাটি শহরের শেষ প্রান্তে কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেঁষে অবস্থিত সরকারী পর্যটন মোটেল। পর্যটকদের জন্য খুবই দৃষ্টিকাড়া ও আকর্ষনীয় স্থান এটি।পর্যটন মোটেলেই অবস্থিত ঝুলন্ত ব্রীজটি, যা পর্যটন এলাকাকে আরও বেশি সুন্দর ও দৃষ্টি-নন্দিত করে তুলেছে। সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এটি। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষনের কারনে এবং এর নির্মান শৈলির কারনে ঝুলন্ত ব্রীজ আজ রাঙামাটির নিদর্শন হয়ে দাড়িয়ে আছে।

পেদা টিং টিংঃ কাপ্তাই হ্রদের চারিদিকে কেবল পাহাড় আর হ্রদ, যেন প্রকৃতির মাঝে আপিন এক আগন্তুক মাত্র। বুনো প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না সেখানে। কিন্তু আপনি অবাক হবেন যখন চলতি পথে কোন একটি টিলার উপর দেখিবেন “পেদা টিং টিং”। এমন এক পরিবেশে যেখানে আপনি এক গ্লাস খাবার
পানি পাবেন না, সেখানে পেদা টিং টিং আপনার জন্য চা, কফি আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে অপেক্ষা করছে। সত্যিই হতবাক করার মত ব্যাপার। পেদা টিং টিং একটা চাকমা শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ হচ্ছে পেট টান টান। অর্থাৎ মারাত্মক ভাবে খাওয়ার পর পেটের যে টান টান অবস্থা থাকে, সেটাকেই বলা হয় পেদা টিং টিং।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাদুঘরঃ রাঙামাটি শহরের প্রধান রাস্তার পাশেই এই জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে। আদিবাসীদের কৃষ্টি,সংস্কৃতি, জীবনধারার নানান নিদর্শন ও ব্যবহারী জিনিসপত্র সেখানে রাখা হয়েছে।

তবলছড়ি চাকমা বাজারঃ রাঙামাটি শহরে এটি হলো একটি প্রধান আদিবাসী বাজার। সপ্তাহে বুধ এবং শনিবার এ বাজার বসে। আদিবাসী কিশোর-কিশোরী, নারী এবং পুরুষরা এখানে আসে নানা ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে। পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে মেশার, তাদের সঙ্গে কথা বলার এ হলো আপনার জন্য চমৎকার সুযোগ।

কাসালংঃ জলপথে যেতে হয় কাসালং রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে প্রতিদিন সকাল আটটায় কাসালংয়ের উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছেড়ে যায়। লঞ্চে যেতে যেতে নদীর দুই পাশের দৃশ্যাবলীও আপনাকে পুলকিত করবে। কাসালংয়ে ছোট-বড় বেশ কটি ঝরনা রয়েছে। এসব ঝরনার শব্দ আপনার কানে বৃষ্টির শব্দের মতো অনুভূত হবে।

আসামবস্তি সেতুঃ এটি রাঙামাটিস্থ সব চেয়ে দীর্ঘ সেতু। এটি আসামবস্তি এলাকায় অবস্থিত। রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই যাওয়ার সময় এই সেতু পাড়ি দিতে হয়। প্রতিদিন বিকেল বেলায় প্রচুর পর্যটক ও সরনার্থীর সমাগম ঘটে। পাশাপাশি এখন ব্রাক্ষনটিলা সেতুটিতে প্রচুর সমাগম হচ্ছে।

কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা হতে রাঙামাটি পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি বাস প্রতিদিন ছেড়ে যায় রাঙামাটির উদ্দেশ্যে। শ্যামলী, সায়েদাবাদ, কলাবাগান হতে প্রতিদিনই এস.আলম, ইউনিক,শ্যামলী,ডলফিন ও বি,আর,টি,সি সার্ভিস বাসগুলো ছাড়ে। এগুলোর মাধ্যমে সরাসরি চলে আসতে পারেন রাঙামাটি (ভাড়া ৬৫০-৯৫০ টাকা) । অথবা ঢাকা বা অন্য জেলা হতে বাসে, ট্রেনে কিংবা বিমানে করে যেতে পারেন চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম হতে বি,আর,টি,সি, পাহাড়িকা,দ্রুতযান সার্ভিস রয়েছে রাঙামাটি পর্যন্ত (ভাড়া ১০০-১৮০ টাকা ) সেগুলোর মাধ্যমেও পৌছতে পারেন রাঙামাটি। তবে সরাসরি বাস সার্ভিসই ঝামেলা ও ঝুঁকিমুক্ত।

কোথায় থাকবেনঃ- থাকার জন্য রাঙামাটিতে অনেক গুলো হোটেল ও গেষ্ট-হাউজ রয়েছে। তাছাড়া আরো কিছু বোডিং পাওয়া যায় থাকার জন্য। বোডিংগুলোতে খরচ কিছুটা কম হলেও,তবে থাকার জন্য খুব একটা সুবিধার নয়।

উচ্চ মানের হোটেলঃ হোটেল সুফিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সাংহাই ইন্টার ন্যাশনাল, হোটেল প্রিন্স,হোটেল গ্রীন ক্যাসেল,হোটেল নাদিসা ইন্টারন্যাশনাল,হোটেল নিডস হিল ভিউ,পর্যটন হলিডে কমপেক্স,হোটেল ডিগনিটি ও পর্যটন মোটেল সহ ইত্যাদি।

মাধ্যম মানের হোটেলঃ হোটেল আলমোবা,হোটেল ড্রীম-ওয়ে,হোটেল ডি-মারিনা,হোটেল লেকসিটি,হোটেল সৈকত,হোটেল আনিকা,হোটেল শাপলা, হোটেল শুকতারা,হোটেল আল-হেলাল, হোটেল পাহাড়িকা ও হোটেল রাজু অন্যতম ইত্যাদি।

হোটেল ভাড়াঃ ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা পর্যন্ত। নরমাল ও শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত দুইটাই উপভোগ করা যাবে।

খাবার-দাবার: উপরোক্ত উচ্চ মানের হোটেল গুলোর বেশির ভাগই রেষ্টুরেন্ট সহ। তবে অন্য হোটেল গুলোর মধ্যে সব কটির আশে-পাশেই খাওয়ার রেষ্টুরেন্ট আছে। বেশ চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
তবে স্পেশাল কিছু রেসিপি পাওয়া যায়।

সুবিধাঃ রাঙামাটি শহরে মোটেই যান-জট হয় না। কাজেই স্বস্তিতে ঘুরা ফেরা করতে পারবেন। এখানে চিনতাই বিষয়টা একদমই কম। দিনে ও রাতে ঘুরতে পারবেন নিচিন্তে।

অসুবিধাঃ শহরে টেক্সি ভাড়াটা অন্যান্য শহরের তুলনায় একটু বেশি। তবে যাতাযাতের একমাত্র পাবলিক জার্নি হিসেবে টেক্সি-টাই উপায়। ভাড়া বনরুপা থেকে রিজার্ভবাজার কিংবা তবলছড়িতে বারো টাকা। তবলছড়ি থেকে রিজার্ভ বাজার ও বনরুপায় একই ভাড়া। আবার রিজার্ভবাজার থেকে তবলছড়ি কিংবা বনরুপায় একই ভাড়া বারো টাকা। বনরুপা থেকে কলেজ গেইট পর্যন্ত দশ টাকা।

লেখক: প্রান্ত রনি, সংবাদকর্মী



মন্তব্য চালু নেই