উড়ালসড়ক : খরচ বাড়লেও এগোচ্ছে না কাজ

জমি কেনা, পুনর্বাসন ও বেতন-ভাতার পেছনে ইতিমধ্যে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে সরকার। এই খাতে আরও ১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু চুক্তি সইয়ের ছয় বছরেও ঢাকা উড়ালসড়কের মূল কাজ পুরোদমে শুরু করতে পারেনি ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।

সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগে (পিপিপি) ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। এটি নির্মিত হওয়ার কথা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে রেলপথ ধরে। আর সড়কটি মিলবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গিয়ে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার।

প্রকল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত। মূল উড়ালসড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

আর এই প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে সরকার আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও নানা কেনাকাটা রয়েছে।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রথমে উড়ালসড়ক নির্মাণে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ইটাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। মূল চুক্তিতে উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ২৬ কিলোমিটার। পরে এটি কমে হয়েছে ২০ কিলোমিটার। নকশা পরিবর্তন ও মূল্যস্ফীতির কথা বলে প্রায় তিন বছর পর ব্যয় বাড়িয়ে পুনরায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায় চুক্তি করে সরকার। চুক্তি অনুসারে, ইটাল-থাই কোম্পানির খরচ করার কথা ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। আর সরকারের ভাগে পড়েছে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।

মূল চুক্তির কয়েক মাস পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পুনরায় চুক্তির পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কাজে গতি পায়নি।

নথিপত্র বলছে, গত মার্চ পর্যন্ত বিমানবন্দরের কাছ থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ৬৪৭টি পাইল বসানো হয়েছে। ৪৩টি পাইল ক্যাপ (উড়ালসড়কের খুঁটির গোড়ার কাজ) করা হয়েছে। দুটি কলাম নির্মাণ হয়েছে এবং আটটি কলামের কিছু কাজ হয়েছে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, কিছু সংযোগ সড়ক ও ছোট উড়ালসড়ক ছাড়া গত দেড়-দুই দশকে ঢাকার সড়ক বাড়েনি। কম জমি অধিগ্রহণ ও মানুষের কম ক্ষতি করে উড়ালসড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যাবে। এরপরও সময়ক্ষেপণ দুঃখজনক। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ ফার্মগেট বা কারওয়ান বাজার পর্যন্ত চলে এলে ঢাকা অচল হয়ে পড়বে। উড়ালসড়কটি থাকলে কিছুটা হলেও দুর্ভোগ লাঘব হতো।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বিমানবন্দর ও কুড়িল উড়ালসড়কের মাঝখানে প্রায় ১৬ একর এলাকা ঘিরে রেখেছে ইটাল-থাই কোম্পানি। এর ভেতরে প্রকল্পের অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু স্থানে মাটি উন্নয়নের কাজ চলছে। কিছু পাইলিংয়ের কাজও চলছে।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ইটাল-থাই কোম্পানি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ জোগাড় করার চেষ্টা করেও পায়নি। এ জন্যই কাজ শুরু করতে পারেনি। আর একবার কাজ দেরি হওয়ার কারণে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এখন চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ইটাল-থাই। এখন অর্থায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমাদের কাছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থের সংকটের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, চীনা কোম্পানির কাছ থেকে চলতি মাসেই অর্থ আসছে। এরপর আর কাজে কোনো ব্যাঘাত হবে না। সরকারের মেয়াদের মধ্যে প্রথম ধাপের অর্থাৎ বিমানবন্দর কাছ থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ করা হবে।

সরকারের ব্যয় বেড়েছে
ইটাল-থাই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করার পরই জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনসহ উড়ালসড়কের সহায়ক প্রকল্পও নেয় সরকার। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা।

এই প্রকল্পের অধীনে ইতিমধ্যে জমি কেনা শেষ পর্যায়ে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে ভবন তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি সেতু বিভাগ প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বৃদ্ধি করেছে। বাড়িয়েছে সময়ও। এখন জমি কেনা ও পুনর্বাসন প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, উড়ালসড়কের পথের কিছুটা সংশোধন, সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও নির্মাণকাজে বিলম্ব, পুনর্বাসন ব্যয় বৃদ্ধি, গাড়িসহ বাড়তি কেনা কাটার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়েছে।

রেললাইন থাকবে নিচে, এর ওপর দিয়ে যাবে উড়ালসড়ক। ফলে প্রকল্পের প্রায় সব জমিই রেলের এবং তারা এই জমি সেতু বিভাগকে বরাদ্দ করে দিয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন মাত্র ২৬ একর জমি কেনা হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য ৮৫০ থেকে ১ হাজার বর্গফুটের ১২টি ভবন ও একটি মার্কেট নির্মাণ করার কথা রয়েছে। প্রকল্প এলাকা থেকে সেবা সংস্থার লাইন অপসারণেই ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের জন্য ১৬টি গাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৬টি গাড়ির মধ্যে পাজেরোই ৯টি। ৩টি মাইক্রোবাস ও পিকআপ ৪টি। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব গাড়ির পেছনে ১০ কোটি টাকা ব্যয় দাঁড়াতে পারে।
এই বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সরকারের নীতি হচ্ছে প্রকল্প তোলার জন্য যেখানে যত টাকা প্রয়োজন, তা খরচ করা হবে। ব্যয় বৃদ্ধি প্রয়োজন হলে তো করতেই হবে।

চুক্তি ও প্রকল্পে যা থাকছে
উড়ালসড়কের নির্মাণ সময় ধরা হয়েছে সাড়ে তিন বছর। ইটাল-থাই কোম্পানির সঙ্গে নির্মাণ সময়সহ ২৫ বছরের জন্য চুক্তি হয়েছে। এ সময় যে টোল আদায় হবে, তা থেকে বিনিয়োগ ও মুনাফা তুলে নেবে কোম্পানিটি। নির্মাণকাজ করা হবে তিন ধাপে।

প্রথম ধাপে নির্মিত হবে বিমানবন্দরের কাছ থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। এই ধাপের জন্য ৬৯ একর জমি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেবা সংস্থার লাইনও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অংশের দৈর্ঘ্য সাড়ে সাত কিলোমিটার। দ্বিতীয় ধাপে নির্মিত হওয়ার বনানী থেকে মগবাজার রেলগেট পর্যন্ত, যার দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। বাকি প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার নির্মিত হওয়ার কথা তৃতীয় ধাপে। এর বাইরে সোনারগাঁও হোটেলের কাছ থেকে পলাশী পর্যন্ত একটি সংযোগ সড়কসহ ৩১টি ওঠা-নামার পথ (র‍্যাম্প) নির্মাণ করা হবে। এসব র‍্যাম্পের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ কিলোমিটার।সূত্র : প্রথম আলো।



মন্তব্য চালু নেই