যশোরে উদীচী ট্রাজেডি :
উচ্ছেদ আশঙ্কায় নিহত তপনের বৃদ্ধা মা
উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় নিহত তপনের পরিবার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পথে। জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়ে যে বাড়িটিতে পরিবারটি বসবাস করে, পুলিশ প্রশাসন দাবি করছে, সেটি তাদের।
বোমা বিস্ফোরণে নিহত নাজমুল হুদা তপন ছিলেন পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার বৃদ্ধা মা সামসুন্নাহারের আকুতি- ‘বাবা আমরা যেন বাড়িটিতে থাকতে পারি, দেখ তার ব্যবস্থা করতে পার কি না।’
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ মধ্যরাতে যশোর টাউন হল মাঠে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিন ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এটি ছিল বাংলাদেশে ব্যাপক ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন বোমা হামলার প্রথম ঘটনা। দুটি বোমার বিস্ফোরণে সেদিন মারা যান শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীসহ দশজন। আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। এদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
পুলিশে চাকরি করতেন নাজমুল হুদা তপনের বাবা রজবউদ্দিন আহমেদ। চাকরিকালেই তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে শহরের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সড়কে তৎকালীন চেম্বার অব কমার্স ভবনের (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়) পেছনে পাঁচ শতক জমির ওপর একটি জরাজীর্ণ ভবন বরাদ্দ নিয়ে বসবাস করতেন। রজবউদ্দিনের অবসর গ্রহণ ও মৃত্যুর পরও ওই বাড়িতে বসবাস করতে থাকে পরিবারটি। রজবউদ্দিনের একমাত্র ছেলে তপন উদীচী যশোরের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৯ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাঠে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
৬ মার্চ রাত একটা দশ মিনিটে এ অনুষ্ঠানস্থলে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ব্যাপক ধ্বংসাত্মক বোমা বিস্ফোরণ। এতে প্রাণ হারান তপনসহ দশজন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মর্মান্তিক মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়ে পরিবারটি।
ছেলের আকস্মিক মৃত্যুর পর তপনের মা সামসুন্নাহার রেনু বসবাসের বাড়িটি তার নামে স্থায়ী বরাদ্দ প্রদান ও আর্থিক সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। কিন্তু এর পর পরই সরকার বদল হওয়ায় সে আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে যায়।
সামসুন্নাহার জানান, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করলে তিনি ফের আবেদন করেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তপনের পরিবারের নামে বরাদ্দ করা বাড়িসহ জমিটি স্থায়ীভাবে প্রদানের নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসককে। এই নির্দেশের বলে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসক তপনের মা সামসুন্নাহার রেনুর নামে পাঁচ শতক জমিসহ জরাজীর্ণ ভবনটি সাফ কবলা দলিলমূলে রেজিস্ট্রি করে দেন। এরপর পরিবারটি জমির অনুকূলে খাজনাও পরিশোধ করে আসছে।
প্রিয় সন্তান হত্যার বিচার না পেলেও বাড়িটিতে মোটামুটি স্বস্তিতেই বসবাস করছিল পরিবারটি। কিন্তু জেলা পুলিশ প্রশাসন জমিটি তাদের বলে দাবি করায় বিপাকে পড়েছেন নিহত তপনের পরিবার-সদস্যরা।
তপনের বোন নাজমুন সুলতানা বিউটি জানান, সম্প্রতি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার জমি মাপজোক করে দাবি করেছেন, তাদের নামে বরাদ্দ হওয়া জমির মধ্যে দুই শতক পুলিশের। এজন্য পুলিশ কর্মকর্তারা দ্রুত ওই জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন। গত ২ মার্চও পুলিশ তাদের জমি ছাড়তে বলে আসে।
জমি-বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন- এ চিন্তায় ঘুম নেই সামসুন্নাহারের। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে আলাপের জন্য যশোরের পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও পারেননি।
সামসুন্নাহার ও তার মেয়ে নাজমুন সুলতানা বিউটি দাবি করেন, পুলিশ যে দুই শতক জমি দাবি করছে, তা আসলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র সড়ক-সংলগ্ন। সেই জমিতে এখন একটি শ্রমিক সংগঠন, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং সরকারি দলের একজন এমপির বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। প্রভাবশালী এসব সংগঠন ও ব্যক্তির কাছ থেকে জমি উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।
জানতে চাইলে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ‘শুধু সামসুন্নাহারের অংশই নয়, দড়াটানা থেকে চিত্রামোড় পর্যন্ত নেতাজী সুভাষচন্দ্র সড়কের দক্ষিণ পাশের পুরো জমির মালিকই পুলিশ বিভাগ। এমনকি জেলা আওয়ামী লীগের অফিস, বিদ্যুৎ অফিসও।’
প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘ওই জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। একমাত্র আদালতের নির্দেশেই বিষয়টির ফয়সালা হতে হবে।’
পুলিশ সুপার প্রশ্ন রাখেন- ‘পুলিশের জমি জেলা প্রশাসন অন্য কাউকে বরাদ্দ দেয় কীভাবে?’
এদিকে, সরেজমিনে দেখা গেছে, যে বাড়িটি নিয়ে পুলিশ প্রশাসন ও নিহত তপনের পরিবারের মধ্যে টানাহেঁচড়া চলছে, তা নিতান্তই বসবাসের অনুপযোগী। ছাদের পলেস্তারা খসে বেরিয়ে এসেছে রড। আশঙ্কা রয়েছে ধসে পড়ারও। বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে পানি ঝরে অনর্গল। তখন পরিবারটিকে পড়তে হয় সীমাহীন দুর্দশায়।
তপনের বোন বিউটি বলেন, ‘বৃদ্ধা মাকে নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি এই জীর্ণ ভবনটিতে। এটি হাতছাড়া হলে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
তপনের মা সামসুন্নাহার তার বাড়িটি রক্ষা ও সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
মন্তব্য চালু নেই