ঈদুল আযহার মাহাত্ম্য : পশুত্বকে কোরবানী

আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
আযহা শব্দ জুবেহ থেকে উৎপত্তি। জবেহ করা ক্রিয়াপদ আর আযহা অর্থাৎ জুবেহ বা জবেহ বিশেষ্য পদ। যার অর্থ কোরবানী। কোরবান বা কোরবানী শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবর শব্দমূল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কুবরের অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাহলে ঈদুল আযহার অর্থ দাড়ায় কোরবানী বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কোরবানী। কোরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বড় মাধ্যম। প্রকৃত অর্থে নিজেকে আমৃত্যু আল্লাহর রাস্তায় সমপর্ন করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য পশু জবেহ করাকে কোরবানী বলা হয়। কোরবানী করা ওয়াজিব। আল্লাহর নবী হযরত ইব্্রাহীম (আঃ) এর স্বীয় পুত্র ঈসমাইল (আঃ)কে কোরবানী করার পরীক্ষা থেকে বর্তমান পদ্ধতির কোরবানীর সূচনা হয়েছে। ইসলামী শরীয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কোরবানীতুল্য। এ কোরবানী হতে পারে জানের, মালের, সম্পদের, সময়ের, স্বার্থের, সামর্থের, ইচ্ছার ও পশুর কোরবানী। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগ – এটাই হলো কোরবানী।
ঈদুল আযহাকে ঈদুল কবির অর্থাৎ মহান ঈদ বলা হয়। কেননা এ হচ্ছে এমন এক কোরবানীর ঈদ যা বিশ্বব্যাপী মুসলমানগণ উদযাপন করে থাকে। দিনটি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মরণিকা। দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত সুখ আর আনন্দের ঠিকানা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ।
ঈদুল আযহার অর্থ নিছক পশু হত্যা নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। তাই কবির ভাষায় বলতে হয় “ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন”। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপনের স্বর্ণফসলই হলো কোরবানী। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর কোরবানীর পূর্ণ স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র ঈদুল আজহা। কোরবানী নিছক একটা আনন্দ উৎসব নয়, এর সাথে জড়িত রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। পাঁচ হাজার বছর আগে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের জন্য নিজের পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)কে জবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। ঐ ঘটনাকে স্মরণ করে কোরবানীর ঈদ বা ঈদুল আযহা প্রবর্তিত হয়েছে। তাই ঈদুল আযহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জ্বীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব। কোরবানীর দেয়ার ক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য অনুসরনীয় ও অনুকরনীয় আদর্শ স্থাপন করেন।
আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের কোরবানী কবুল করেন। মুত্তাকী হচ্ছেন তারাই যারা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও পরহেজগারী অবলম্বন ও অর্জন করেন। তাকওয়া ও পরহেজগারী হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, পাপ-পংকিলতা থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলা। মুত্তাকীর শ্রেষ্টত্ব নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি হলো তাকওয়া ও পরহেজগারী। লক্ষণীয় যে, কোরবানীর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা। পশু কোরবানী হচ্ছে আত্ম কোরবানীর প্রতীক। কোরবানীর পশু জবাই আসলেই প্রতীকি ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার কাছে পৌছে না। পৌছে শুধু তাকওয়া ও পরহেজগারী।
শুধু পশু নয়, প্রয়োজনে পশুত্বের কোরবানী দিতে হয়। প্রতিটি মানুষের ভিতর একটি হিংস্র পশু আছে যেটা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ঠ আত্মা। মানুষের অন্তরআত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ঠ আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে কোরবানী করার পর পশু কোরবানী করা উচিৎ। হযরত ইসমাইল (আঃ)কে কোরবানী করার আগে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) নিজের জীবনকে কোরবানী করেছিলেন সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। যে মুসলমান ঈমানের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে নিজের পশুত্বকে কোরবানী করবে সেই কামিয়াবী এবং তার জন্য পরকালের অনন্ত জীবনে রয়েছে বেহেশত। বস্তুত কোরবানীর প্রকৃত স্বার্থকতা কোরবানীদাতার কু-প্রবৃত্তি সমূহ বিসর্জনের মাধ্যমে নিহিত থাকে।
ইতিহাসে পাওয়া যায়, কোরবানী দেয়ার রীতিটি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) এর সময়কালেও কোরবানীর রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানী হযরত আদম (আঃ) এর সুন্নত ও আদর্শ। সেসময় কোরবানীকৃত দ্রব্য পাহাড়ের চূড়ায় বা কোন উঁচু স্থানে রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নি বর্ষিত হয়ে পুড়ে যেতো তাহলে কোরবানী আল্লাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। পবিত্র আল কোরআন মজিদে হযরত আদম (আঃ) এর দুই পুত্রের কথা উল্লেখ করে সেসময়কার একটি কোরবানীর ঘটনা উল্লেখ আছে।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর কোরবানী ছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কোরবানী। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আদর্শের তাত্ত্বিক ও বাস্তব রূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ্ব ও কোরবানীর অনুষ্ঠান। কিন্তু দূঃখের বিষয় বর্তমানে বিজাতীয় অপসং®কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত হেনেছে। যার ফলে মুসলিম পরিবারের সদস্যরা আজ ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করায় তাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে পদদলিত।
মহান স্রষ্ঠার প্রতি যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তাঁর সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সব্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষনায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয় সারা বিশ্বে। এ উৎসব আত্ম বিশ্লেষন ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কোরবানীর উৎসব। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোরবানীর দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করার জন্য আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে, যা আমার উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআলা ঈদ বানিয়ে দিয়েছেন। কোরআন হাদিসের আলোকে জ্ঞান অর্জন করে সঠিক দায়িত্ব-কর্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের যদি আল্লাহর রাস্তায় কোরবানী করা যেতো তাহলে আজ আমাদের সমাজে এমন অশান্তি, অরাজকতা ও ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করতো না।
ঈদুল আযহা পশু হত্যার পর্ব কিংবা চিত্ত বৈভব প্রদর্শনের উৎসব নয়। ঈদুল আযহা ত্যাগের, আত্মসমর্পনের এবং আত্মোপলব্ধির মহান স্মারক।

লেখক: আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
ডেপুটি রেজিস্টার, নর্দাণ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক,
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোর।



মন্তব্য চালু নেই