আসতে পারে লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ কর্মসূচি

দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেওয়া ৭ দফা প্রস্তাবের আলোকে ব্যবস্থা নিতে আবারও সরকারকে সময় বেঁধে দেবে বিএনপি। এ জন্য ২১ অথবা ২২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন করে সংলাপের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

সংবাদ সম্মেলনের পর ওই আহ্বানে সরকার সাড়া না দিলে পরবর্তী সময়ে চলমান অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করবে ২০ দলীয় জোট।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও গুলশান কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ কয়েক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে। বিএনপি সূত্র জানায়, চলমান অবরোধ কর্মসূচির সফলতায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট সন্তুষ্ট।

সরকারের অস্বীকার ও বাগাড়ম্বরতা সত্ত্বেও সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। স্থবির হয়ে গেছে অর্থনীতির চাকা। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কল-কারখানার উৎপাদনও। থেমে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এভাবে একটি স্বাধীন দেশের সরকার সচল থাকতে পারে না। সরকার যতই অবরোধ ব্যর্থ, ব্যর্থ বলে বাগাড়ম্বর করুক না কেন, সরকারের গতি যে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছে তা স্বীকারও করেছেন মন্ত্রীরা।

গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের কাছে নাজুক পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে অবস্থায় চলে গেছে, তা সরকারের ধারণারও বাইরে।

সূত্র জানায়, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থায় চলমান ও সামনের আন্দোলন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতাকর্মীরা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। আন্দোলনের যে কোনো মুহূর্তে সরকার তাকে গ্রেফতারও করতে পারে, আর গ্রেফতারপরবর্তী চলমান আন্দোলন টেনে নেওয়ার দায়িত্ব দলের কোন কোন নেতা পালন করবেন সে ব্যাপারেও ভেবে রেখেছেন খালেদা জিয়া।

সে ক্ষেত্রে দলের একজন গ্রহণযোগ্য, সক্ষম ও বিশ্বস্ত নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এ ছাড়া মাঝপর্যায়ের তিনজন নেতা ও মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকে বিশেষ মুহূর্তে যে কোনো কঠিন দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত থাকতে ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসন। এ সব নেতাকে গ্রেফতার এড়িয়ে ঝুঁকিমুক্ত থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্যও বলা হয়েছে।

বিএনপি সূত্র জানায়, গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের পর সরকার বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কার্যকর সংলাপের পথে না হাঁটলে ফেব্রুয়ারির শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। একই সঙ্গে চলমান অবরোধের পাশাপাশি টানা হরতাল কর্মসূচিও আসতে পারে। এ সব কর্মসূচির বিষয়ে তিনি ইতোমধ্যে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’ সেরে ফেলেছেন। অসহযোগের বিষয়ে জোট শরিক জামায়াতসহ অন্য শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সম্মতিও নিয়েছেন তিনি।

খালেদা জিয়া ‘অবরুদ্ধ’ হওয়ার শুরুর দিন থেকেই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আছেন বিএনপির এমন একজন সিনিয়র নেতা জানান, দাবি না মানলে কোনোভাবেই আন্দোলন স্থগিতের পরিকল্পনা খালেদা জিয়ার নেই। শুরুর দিকে রাজপথে সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতির ঘটনায় আন্দোলন বিরতিহীন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা সংশয়ে থাকলেও বর্তমান সেই সংশয় কেটে গেছে। পদধারী নেতারা ‘নিখোঁজ’ হওয়ার পরও সারা দেশে মাঠের কর্মীরা যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে তিনি (খালেদা) মাঠকর্মীদের প্রতি সন্তুষ্ট।

তিনি (খালেদা জিয়া) মনে করছেন, আন্দোলন সফল না হওয়ার আগে পিছিয়ে আসলে নতুন করে দল ও দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। সারা দেশে ক্ষমতাসীনদের তাণ্ডব ও হামলার পাশাপাশি মামলা এবং পুলিশি হয়রানি অব্যাহত থাকবে। এ জন্য আন্দোলন থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে আসবেন না তিনি।

আন্দোলনের এ পর্যায়ে বিএনপি অসহযোগ কর্মসূচির কথা ভাবছে কি না এমন জিজ্ঞাসায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সময়ের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন কোন গতিতে ও কোন কৌশলে চলবে। সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে গতি, কৌশল ও কর্মসূচি নির্ধারিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘সংকট নিরসনে আমরা চাই একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য সংলাপ। কারণ গণতন্ত্রে মূল ভাষা হচ্ছে সংলাপ। সরকার যদি সংলাপে গুরুত্ব না দেয় তাহলে অসহযোগ আসতে পারে।’

অসহযোগের ধরন কী হতে পারে, এমন প্রশ্নে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মাহবুব বলেন, ‘এটা এখনও ঠিক করা হয়নি। দলে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে। বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ হতে পারে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তবে এগুলো এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’

জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, ‘আমরা সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসন চাই। কিন্তু সরকার পাত্তা দিচ্ছে না। উল্টো আমাদের নেতাদের যেখানে-সেখানে গুলি করে মারছে, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বিএনপি নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছে। সন্ত্রাসকে উস্কে দিচ্ছেন তারা। সরকার তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় অবরোধ-হরতালের মধ্যে সরকারের শুভবুদ্ধির উদ্ভব না ঘটলে অসহযোগ আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কিছুই থাকবে না। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাব।’

সূত্র জানায়, সরকার দ্রুত কার্যকর সংলাপে না বসলে ফেব্রুয়ারি থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারে প্রস্তুত হতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে, অসহযোগের ধরন কী হতে পারে এখনও তিনি খোলাসা করেননি। প্রযোজ্য সময়েই এ নির্দেশনা সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, ৩ জানুয়ারি অবরুদ্ধ হওয়ার পর খালেদা জিয়া একাই সারাদেশের আন্দোলন মনিটর করছেন। তিনি নিয়মিত জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। ওইসব ফোনালাপে অহিংস পথে আন্দোলন আরও তীব্র করে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি উপজেলায় আন্দোলন তীব্র করা না গেলে এক এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অন্য এলাকায় গিয়ে যৌথভাবে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন দমনে ভূমিকা রাখবে। সে ক্ষেত্রে এলাকা থেকে এলাকা বিচ্ছিন্ন করে প্রতিটি এলাকায় আন্দোলন আরও জোরদার করা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ নাও পেতে পারে।’

এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের অসহযোগ কর্মসূচির বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। কর্মসূচি ঘোষণার পর এ সব পেশাজীবী সংগঠন তাদের অনুসারীদের সরকারি কর্মকাণ্ডে কোনো সহযোগিতা না করার নির্দেশ দেবে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট সূত্র জানায়, অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে সারা দেশে মামলার শিকার কোনো নেতাকর্মী আদালতে হাজিরা দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত অবৈধ অনৈতিক সরকার পদত্যাগ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত নেতাকর্মী, অনুসারী ও সাধারণ জনগণ যাতে কোনো ধরনের ট্যাক্স না দেয় সে আহ্বানও জানাবে ২০ দল।

সুপ্রীম কোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলার আইনজীবী সমিতি বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটপন্থীদের দখলে। এটাও জোটের অসহযোগ কর্মসূচিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে জোট নেতারা মনে করেন। মূলত এ কর্মসূচি ঘোষণার পর দেশের আদালতগুলো অচল করার লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছেন জোট নেতারা।

২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া অসহযোগ কর্মসূচির ব্যাপারে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী চান, সংলাপের মধ্য দিয়ে দেশের চলমান সমস্যা সমাধান করতে হবে। সমাধান প্রত্যাশা করেই আমাদের জোট নেত্রী সরকারের উদ্দেশে ৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু সরকার কোনো সাড়া দেয়নি। সরকার দেশকে সংঘর্ষের পথে নিয়ে গেছে। আজকের এ অরাজক পরিস্থিতির জন্য সরকারই এককভাবে দায়ী।’

মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ‘জোট নেত্রীর আহ্বানে সরকার সাড়া না দিলে চলমান অবরোধ কর্মসূচির সঙ্গে লাগাতার হরতাল আসবে। এটাই পরে অসহযোগে রূপান্তরিত হবে। অসহযোগিতার মাধ্যমে এ গণবিচ্ছিন্ন অবৈধ সরকারকে দেশ ও বিদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে। যাতে করে তারা জনগণের দাবি মোতাবেক সংলাপে বাধ্য হয়।’

অসহযোগের ধরন সম্পর্কে ন্যাপ মহাসচিব বলেন, ‘সরকার অবৈধ হলেও আমাদের দেশ তো স্বাধীন। আমরা পরাধীন দেশের মতো অসহযোগ কর্মসূচি দিতে পারি না, তা চাইও না। সে জন্য আমাদের দেশের সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা অসহযোগ কর্মসূচি নির্ধারণ করব।’

দেশের চিকিৎসকদের বৃহৎ সংগঠন ডক্টরস এ্যাসোসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) উচ্চ পর্যায়ের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘দেশের চিকিৎসকদের সর্ববৃহৎ সংগঠন ড্যাব শুধু অসহযোগ নয়, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) যে কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। অসহযোগ এলে ড্যাব তা কার্যকর করতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।’



মন্তব্য চালু নেই