আশরাফকে কাছেই রাখলেন হাসিনা
এক সপ্তাহ আগে দপ্তরছাড়া করার মধ্য দিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দূরে ঠেলে দেওয়ার যে গুঞ্জন ডাল-পালা মেলছিল, তাকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে ফিরিয়ে এনে দৃশ্যত তা ছেঁটে দিলেন শেখ হাসিনা।
“পুরো বিষয়টিই ভাই-বোনের বিষয়। এই নিয়ে কথা না বলাই ভালো,” আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের এক নেতার এই প্রতিক্রিয়ার যথার্থতা মিলল নতুন সিদ্ধান্তে।
শেখ হাসিনার কিছু না বলা এবং সচরাচর গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলা আশরাফের নীরবতায় নানা প্রশ্নের উদ্রেক হলেও দলের কেউ খোলাসা করে কিছু বলছিলেন না।
আর এর মধ্যেই আশরাফ লন্ডন যাওয়ার পরিকল্পনা করলে সৃষ্টি হয় নানা গুঞ্জন। ‘দূরে’ ঠেলে দেওয়া আশরাফের ফেরা নিয়ে কারও কারও মনে সংশয়ও দেখা দেয়।
এসব আলোচনার মধ্যেই দলীয় সাধারণ সম্পাদক আশরাফকে নতুন দপ্তর দিয়ে দৃশ্যত শেখ হাসিনা তার আগের সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়ন করলেন।
জরুরি অবস্থায় বন্দিত্বের মধ্যে আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী নেতারা যখন সংস্কারের দাবি তুলে কার্যত শেখ হাসিনাকে নেতৃত্ব থেকে হটানোর চেষ্টায়, তখন দলীয় সভানেত্রীর সবচেয়ে কাছের লোক হয়ে ওঠেন আশরাফ।
এরপর দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ এবং সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় দপ্তরের ভার তার উপরই দেন শেখ হাসিনা।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কাজে অনিয়মিত থাকার অভিযোগের মধ্যে গত ৭ জুলাই একনেক বৈঠকে শেখ হাসিনা আশরাফকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশের পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার গুঞ্জন সৃষ্টি হয়।
সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসা আশরাফ বিষয়টিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিলেও দুদিনের মধ্যে গুঞ্জন সত্য করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার প্রজ্ঞাপন হয়।
মন্ত্রিত্বের দপ্তর হারানোর পর আরও গুঞ্জন চলার মধ্যে দলীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সক্রিয় থাকা আশরাফ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আমি লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমার পিতা সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, নেতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। এটাই আমার রক্ত।”
আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নজরুলসহ জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়।
যেদিন আশরাফকে অব্যাহিত দেওয়ার গুঞ্জন সৃষ্টি হয়, সেদিনও শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছিলেন আশরাফ। যেদিন প্রজ্ঞাপন হয় দপ্তর ছাড়ানোর, সেদিনও তাদের একান্ত বৈঠক হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করে প্রজ্ঞাপনের পরও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আশরাফ।
দলের সাধারণ সম্পাদককে গত কয়েকদিনে কয়েকদফা ডেকে নিয়ে কথা বলেন শেখ হাসিনা। গত মঙ্গলবার গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার পরই লন্ডন যাত্রা স্থগিত করেন আশরাফ।
সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার সঙ্গে এর আগে কয়েকজন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও আশরাফের গুরুত্ব তাদের চেয়ে বেশি ধরা পড়েছে সাংবাদিকদের চোখে।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে দেশে ফেরার পর আশরাফকে ছাড়া কোনো সংবাদ সম্মেলন করতেন না শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন সভায় প্রারম্ভিক বক্তব্য সচরাচর নিজে দিলেও কয়েকটিতে আশরাফকে এই সুযোগ দিতে দেখা গেছে শেখ হাসিনাকে।
সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার আমলে সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল বন্দি থাকার মধ্যে আশরাফ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। পরে জলিল কারামুক্ত হলেও নেত্রীর চোখে সফল আশরাফ ওই দায়িত্বই পালন করে যান। পরে ২০০৯ সালে কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
এরপর গত সাত বছরে বিডিআর বিদ্রোহ, হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দমনে আশরাফের ভূমিকার প্রশংসা পেয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে।
বিএনপির বর্জনে, পশ্চিমা দেশগুলোর অসন্তোষের মধ্যেই নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে আশরাফের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন দলীয় কর্মীরা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে আশরাফের তির্যক মন্তব্যও আলোচনায় উঠে আসে।
এসবের মধ্যেই সাড়ে ছয় বছর দায়িত্ব পালনের পর আকস্মিকভাবে আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরানো হলে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনার জন্ম দেয়।
তবে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই বলছিলেন, শেখ হাসিনা ও আশরাফের বিষয়ে কোনো কথা না বলাই ভালো।
পরদিন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “হয়ত তিনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেছেন, সে (আশরাফ) অতিরিক্ত ভার বহন করছেন। দলে আরও ভালো করে বেশি সময় দেওয়ার জন্য এটা (দপ্তরবিহীন করা) হতে পারে।”
মন্ত্রী হিসাবে কাজের ধরন নিয়ে গত বছর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এই দুই নেতার মধ্যে তীর্যক মন্তব্য বিনিময় হলে বিষয়টি গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়।
মন্ত্রিসভায় কাউকে রাখা না রাখা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার উল্লেখ করেই ওবায়দুল কাদের বলেন, “তার (প্রধানমন্ত্রী) কোনো সিদ্ধান্ত বেঠিক হয়নি।”
দপ্তরবিহীন করার পর দলীয় কার্যক্রমে এবং দলীয় প্রধানের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করলেও এই বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি আশরাফ।
এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, মাহবুব-উল আলম হানিফসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন উপদেষ্টাও বাসায় গিয়ে আশরাফের সঙ্গে কথা বলে আসেন।
আশরাফের মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ থাকলেও মুহিত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমার যখনই প্রয়োজন হত, তার বাসায় গিয়ে আলাপ করতাম।”
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আশরাফের নতুনভাবে ফেরার ইঙ্গিতের মধ্যেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার তাকে দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন হয়।
পদোন্নতি-বদলির গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টি সাড়ে ছয় বছর ধরে নিজের কাছেই রেখেছিলেন শেখ হাসিনা। গত বছর নতুন সরকার গঠনের পর ইসমত আরা সাদেককে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন এই দপ্তরে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় নাম বদলে জনপ্রশাসন হওয়ার পর আশরাফই এই মন্ত্রণালয়ের প্রথম পূর্ণ মন্ত্রী। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক সরকার আমলেও তিনি প্রথম মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন এই দপ্তরে।
“অর্থাৎ আশরাফকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই রাখলেন নেত্রী,” বলেন আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা।বিডিনিউজ
মন্তব্য চালু নেই