আশঙ্কাজনকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে
জলবায়ুর পরিবর্তন, অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলন এবং ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহার কমে যাওয়ায় রাজশাহীতে প্রতিবছরই আশংকাজনকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। ফলে একদিকে এখানকার পুকুর-ডোবা, নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে জীববৈচিত্র্যেও দেখা দিয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে রাজশাহীতে ভয়াবহ পনি সংকট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূুপ প্রভাবের পাশাপাশি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ)গভীর নলকূপগুলোও অপরিকল্পিতভাবে নিচ থেকে পানি উত্তোলন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার এটাও অন্যতম একটি কারণ। প্রতি ১০ বছরে পানির স্তর প্রায় ১৪ থেকে ১৫ ফুট নিচে নামছে। মাত্র ৩০ বছর আগে এই জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল মাত্র ৩০ ফুট নিচে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে বর্তমানে পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ৯০ ফুট। এখন ৮০-৯০ ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হয়।
জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে খরা মৌসুমে জেলার পবা উপজেলার পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি। ১৯৯৫ সালে স্তর নেমে দাঁড়ায় ৩০ ফুটে। আবার ২০১০ সালে পানির স্তর নেমেছে প্রায় ৬৬ ফুট। জেলার গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় এ চিত্র আরো ভয়াবহ। এই দুই উপজেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপ বসানোর পূর্বে সর্বোচ্চ ৫৫ ফুট নিচ থেকে পানি উত্তোলন করা যেত। কিন্তু বর্তমানে সেখানে পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩৫ ফুটে। এভাবে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমেই চলেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীতে ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামার কারণ অনুসন্ধানে গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্য’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, বরেন্দ্র অঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় পানির স্তর প্রতি মাসে ০.০০৪ ফুট থেকে ০.০২৮ ফুট হারে নিচে নামছে। ফলে পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাব দেখা দিয়েছে এ অঞ্চলে। আবার সেচের জন্য ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর নিচে নামছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গভীর নলকূপ স্থাপন করে। ফলে বাড়তে থাকে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ। কিন্তু তিন যুগ পরে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে জীববৈচিত্র্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অব্যহত খরায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে রাজশাহী অঞ্চলের জলাধারসহ খালবিল ও নদনদী। এ অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ফলদ ও বনজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক চাষাবাদ।
গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় ১৯৯১ সালের পর থেকে ব্যাপকহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে থাকে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভূগর্ভস্থ জাতীয় সম্পদ পানি অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করায় বেশ কয়েক বছর থেকে এ অঞ্চলে প্রতি ১০ বছরে প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট পানির স্তর নিচে নামছে। বর্ষাকালেও এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে না। এর খেসারত আমাদের অবশ্যই দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এখনই ভূগর্ভের পানি উত্তোলনে সতর্ক না হলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পানি সংকট দেখা দেবে এই রাজশাহীতে।
মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষি শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় প্রচণ্ড দাবদাহ ও খরা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকগুলো ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে রাজশাহীতে। বর্ষাকালেও ভূগর্ভে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকছে না। ফলে ভূউপরিস্থ পানির উৎসগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই খরা মৌসুম শুরুর আগেই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পদ্মাসহ রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, আত্রাই, বারনই, শিব, রাণী (ফকিন্নী) ও ছোট যমুনাসহ ১২টি নদনদী। এ ছাড়া অন্তত ২০টি খাল এখন মৃতপ্রায়। পাশাপাশি কয়েক হাজার পুকুরেও নেই পানি।
জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের কারণে বিগত কয়েক দশকে এ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে। বিশেষ করে একবীজপত্রী উদ্ভিদ যেমন : নারিকেল, সুপারি ও তালগাছ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির প্রাণি এখন চোখেই পড়ে না। পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় অর্ধশত প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে এই অঞ্চলে। এসব হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে বলেও বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল জানান, বিভিন্ন কারণেই এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। ফলে ভূউপরিস্থ পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর উৎসস্থল ভারতে। ভারতের নদী অববাহিকা কেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক পরিকল্পনা রয়েছে। পানি কেন্দ্রিক এসব পরিকল্পনা ভারত একের পর এক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ফলে এ এলাকায় দেখা দিচ্ছে প্রচণ্ড খরা।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি শুধু রাজশাহী অঞ্চলেই নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ঢাকায়।
রাজশাহীর রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, এ অঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশের জন্য পানি সংরক্ষণ আবশ্যক। এজন্য গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ ও উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি। এর ফলে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করে কৃষি সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কমে যাবে এবং সেখানে পানি রিচার্জ হবে। এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যে যে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিয়েছে, তা বন্ধ হবে।
মন্তব্য চালু নেই