আর্তনাদের ৩ বছর, আজও ঝুলে আছে বিচার

রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পূর্ণ হল আজ (২৪ এপ্রিল)। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে, আহত হয় আরো ১ হাজার ৫শ ২৪ জন। এ ঘটনায় দায়ের করা হয় পৃথক দুই মামলা। কিন্তু তিন বছরেও তার বিচার শুরু হয়নি। পলাতক রয়েছে এ মামলার ১২ আসামি।

কিছু লোভাতুর ও দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষের অবহেলা ও নির্মমতার বলি হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্বজনরা আজও কেঁদে বুক ভাসান, বিচারের আশায় তাকিয়ে আছেন সংশ্লিষ্টদের দিকে। যারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন তাদের গলগ্রহ জীবন আর নিঃশব্দ আর্তনাদ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি সেই ভয়াবহ আতঙ্ক থেকে সৃষ্ট মানসিক বিপর্যয়। সবারই প্রত্যাশা দায়ীদের বিচার হবে।

নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৫ সালের ১ জুন রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি বিজয় কৃষ্ণ কর।

মামলা দুটি বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানো হয়েছে। এ মামলা দুটিতে মোট আসামির সংখ্যা ৪১ জন। পলাতক আসামিদের অনুপস্থিতিতেই বিচারের জন্য করার যাবতীয় পদক্ষেপ সম্পন্ন করেছে আদালত।

আগামি ২৮ এপ্রিল সকল আসামিকে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ওইদিন জেলহাজতে থাকা সকল আসামিকেও আদালতে হাজির করা হবে।

ওইদিন মামলাটি বিচারের জন্য আমলে নিবেন আদালত। এরপর চার্জ শুনানির জন্য দিন ধার্য করবেন বিচারক। ধার্য তারিখে শুনানি শেষে চার্জ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, মামলা দুটিতে মোট আসামি হলো ৪১ জন। ৬ জন আসামি জেলহাজতে আটক আছেন। জামিনে আছেন ২৩ জন। বাকী ১২ আসামি রয়েছেন পলাতক।

তিনি আরও বলেন, আসামিদের মধ্যে ১২ জন সরকারি কর্মকর্তাও রয়েছেন। ২৮ এপ্রিল মামলাটি আমলে গ্রহণ ও পরবর্তী তারিখে চার্জ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলা দুটির বিচার শুরু হবে।

এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এবং ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

মামলা দুটিতে মোট ৭২৯ জন সাক্ষি রয়েছে। সাক্ষিদের মধ্যে রয়েছেন নিহতদের স্বজন, জীবিত উদ্ধারকৃত শ্রমিকরা, বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা, উদ্ধারকর্মীরা, বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বিশ্বের শিল্প দুর্ঘটনার ইতিহাসে ভয়াবহতম রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় দন্ডবিধি আইনে এবং ইমারত নির্মান আইনে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়।

অবহেলার দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে দণ্ডবিধি আইনের ৩০৪ক/৩৩৭/৩৩৮ ধারায়। পরে এ মামলাটিতে ৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭ ও ৩০৪ ধারা সংযোজন করা হয়।

এছাড়া অপর মামলাটি করা হয় ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ এর ১২ ধারায়। দণ্ডবিধির মামলায় ৪১ জন ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।

চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন, ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক ও মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌর মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আবু বক্কর সিদ্দিক, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. জামশেদুর রহমান, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী, মো. শহিদুল ইসলাম, ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপণা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মো. শফিকুল ইসলাম ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, রেজাউল ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, নয়ন মিয়া, মো. ইউসুফ আলী, তসলিম ও মাহবুবুল আলম।

ঢাকার জেলা প্রশাসক অফিসে রক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যান। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে। ১ হাজার ৫শ ২৪ জন আহত হন। ২৯১ জনের লাশ অনাক্তকৃত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাবনার বেড়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক আব্দুস সোবহান মারা যান।

এ ঘটনায় দু’টি মামলার মধ্যে একটি মামলা করেছেন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ খান। তিনি ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল সাভার থানায় ফৌজদারি কার্যবিধিতে মামলাটি দায়ের করেন।

অপর মামলাটি দায়ের করেন রাজউকের অথরাইজড অফিসার হেলাল আহম্মেদ। তিনি ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের দিনই জাতীয় ইমারত বিধি লঙ্ঘনের দায়ে মামলাটি দায়ের করেন।

আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২০১৫ সালের ১৩ মার্চ আদালতের নির্দেশে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকার।



মন্তব্য চালু নেই