আফগানিস্তানের আধুনিক রোমিও জুলিয়েট

প্রায় এক বছর পর আফগানিস্তানে নিজ গায়ে ফিরে এসেছে এক দম্পতি। অবশ্য এখন তারা দম্পতি হলেও যখন তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিল তখন তারা ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রেমের স্বীকৃতি নিয়ে গ্রাম পর্যায়ে ঝামেলা শুরু হলে এরা দুইজন গ্রাম থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যায়। পালিয়ে যাওয়ার পর জাকিয়া এবং মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল গ্রামের পঞ্চায়েত। তবে কেন মৃত্যু মাথায় নিয়ে আবারও তারা গ্রামে ফিরে আসলো।
গ্রাম ত্যাগের আগে ২২ বছর বয়সী মোহাম্মদ ছিলেন একজন কৃষক। অন্যান্য ‍আফগান কৃষকের মতো তার কোমরেও ঝোলানো ছিল পিস্তল। তারি বাড়ির সদরদরজার সামনে বাধা থাকতো শিকারী কুকুর। বামিয়ানের প্রায় সবাই নিজেদের রক্ষার্থে অস্ত্র ব্যবহার করে। সেই রীতি অনুযায়ী মোহাম্মদকেও বাড়ির সদস্যদের সুরক্ষায় বন্দুক ব্যবহার করতে হতো। ওদিকে জাকিয়ার সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর সম্পর্কের কথা পরিবার পর্যায়ে জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর একরকম গৃহবন্দী করে রাখা হয় জাকিয়াকে। তার সর্বক্ষণই ভয় করতে থাকে যে, তারই পরিবারের কেউ তাকে গুলি করে হত্যা করবে কিনা। জাকিয়া আর মোহাম্মদ পালিয়ে যাওয়ার পর জাকিয়ার বাবা এবং ভাই মোহাম্মদকে জাকিয়াকে অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন, পাশাপাশি জাকিয়া ও মোহাম্মদকে হত্যার শপথ নেন।
৯‘আমি জানি এখানে এখনও আমাদের জীবনের ঝুঁকি আছে। কিন্তু জন্মভূমির ভালোবাসা অবহেলা করে থাকা যায় না। এই পর্বতের প্রতিটি সরু রাস্তা আমার কাছে অনেক দামি।’ কথাগুলো আবেগাপ্লুত মোহাম্মদের। গত মার্চ মাসের ২১ তারিখ তারা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি পারি দিতে হয়েছে তাদের। কাবুলে যুদ্ধের মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। সেসময় তাকে প্রতিদিন শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো পুলিশ। ওদিকে জাকিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শরণার্থী শিবিরে। সেসময় হঠাৎই একদল আইনজীবি মোহাম্মদের পক্ষে আইনী লড়াই করে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই মোহাম্মদ এবং জাকিয়া আইনকে সাক্ষী রেখে পুনরায় বিয়ে করেন।
বিয়ের পর জাকিয়া অন্তস্বত্ত্বা হওয়ায় তাকে নিয়ে মোহাম্মদ গ্রামে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। গ্রামে ঢোকার মুখেই জাকিয়ারা ভাইয়ের তাড়া খেয়ে কোনোরকমে জানে বেঁচে যায় মোহাম্মদ। এরপর ইয়াকাওলাঙ জেলার একটি গ্রামে বসবাস শুরু করে ওই দম্পতি। ইয়াকালাঙে ভালো ডাক্তার না থাকায় আবারও তারা কাবুলে ফিরে আসেন।
বামিয়ান প্রদেশের নারী সম্পর্ক বিষয়ক দপ্তরের প্রধান আজিজা আহমাদি বলেন, ‘তারা ক্রমাগত ভয়ের ভেতর জীবনযাপন করছে। তারা যদি এখানে থাকে তাহলে তাদের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে। এখন তাদের উচিত এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।’ আজিজাই উদ্যোগি হয়ে দুই পরিবারের মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুই পরিবারেই বক্তব্য যে, তারা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছে তাই তাদের সঙ্গে পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। গত অক্টোবর মাসে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে তাজিকিস্তানে যান ভিসার জন্য, যাতে তারা শরণার্থী হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু ভিসা কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী হতে গেলে মোট পাঁচটি কারণ থাকতে হয়। যদি কারও জীবন আসলেই শঙ্কার মধ্যে থাকে তাহলে আবেদন মঞ্জুর করা যেতে পারে।
এদিকে মোহাম্মদ এবং জাকিয়া বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে, তারা যদি পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে যেতে পারে তবেই তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারে বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ভাগ্যের ফেরে তারা আশ্রয়ের জন্য এদিক ওদিক ঘুরতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক পুলিশ তাদের বন্দোবস্ত করে দেয়া কথা বলে তাদের জমানো প্রায় পাঁচ হাজার ডলারও নিয়ে যায়। শুধু তাই নয় সেই পুলিশ সদস্য ও তার সঙ্গীরা জাকিয়া ও মোহাম্মদের কাছে থাকা মোবাইল, স্বর্ণ ইত্যাদি লুটে নিয়ে যায় এবং তাদের তাজিকিস্তান থেকে বের করে দেয়। এভাবেই পালিয়ে বেড়ানো জীবনের এক পর্যায়ে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেন। গত মাসেই তারা তাদের সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে বামিয়ানে ফিরে গেছেন। এখান তারা প্রকৃতির ক্রোড়ে আছে, দেখা যাক প্রকৃতি তার নিজস্ব দায় মোচন করে কিনা।



মন্তব্য চালু নেই