আত্মহত্যা সব সমস্যার সমাধান নয়
বিশ্লেষকদের ধারণা, আত্মহত্যা সব সমস্যার সমাধান নয়। বরং নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করে। যার কারণে বা যে কারণে ঘটনা ঘটলো সে কিন্তু বড় সমস্যায় পড়ে যায়। অথবা যে কারণে আত্মহত্যা করলো সেই সমস্যা সমাধান না হয়ে আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি হলো। যারা আত্মহত্যা করে তারা নিজের কাছ থেকে মূলত পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু সে জানে না যে, সে একটা খারাপ করছে, একটা মারাত্মক ভুল কাজ করছে। যা শোধরাতে পারবে না।
শিশুর মুখে বিষ দিয়ে মায়ের আত্মহত্যা, ছেলেকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা, পাখি জামা না পেয়ে আত্মহত্যা, হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভাই বোনের আত্মহত্যা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকার আত্মহত্যা, প্রেমিক বিয়ে না করায় প্রেমিকার আত্মহত্যা, একই রশিতে দুই যুগলের আত্মহত্যা, স্ত্রীকে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা, মাকে মেরে ছেলের আত্মহত্যা, পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করায় ছাত্রীর আত্মহত্যা, ভালো রেজাল্ট না হওয়ায় আত্মহত্যা, মায়ের বকা খেয়ে ছেলের আত্মহত্যা, ফুটবল খেলা দেখতে না পেয়ে আত্মহত্যা, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা, অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা, যৌন হয়রানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা, বখাটের অত্যাচারে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা- এরকম অসংখ্য হেডলাইন দিয়ে দেশের পত্র পত্রিকাগুলো সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ একটিও হয়নি। বরং বেড়েছে এ সংখ্যা।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা সম্পর্কিত এক রিপোর্ট পেশ করে।
এদিকে বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের যৌথ এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ৩১১৫ জন। এর মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে ১৯৫৫ জন এবং বিষ পানে ১১৬০ জন।
২০১৩ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১০৮ জন। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার জন (প্রায়)। এবং ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৪২ জন।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে আত্মহননকারীদের মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ১৭৭ জন। অর্থাৎ ওই সালে নারীদের মধ্যে শতকরা ৬১ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯৩১ জন। অর্থাৎ ওই সালে আত্মহননকারী পুরুষের সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৯ শতাংশ। আর আত্মহননকারীদের মধ্যে ২০ বছর থেকে ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত এই প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
যেখানে ভারতে প্রতি ঘন্টায় আত্মহত্যা করেন ১৫ জন। প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যা করেন ৩৭১ জন। আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ৬ হাজার জন।
সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় আত্মহত্যা করেন ১ জনেরও বেশি। প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যা করেন মাত্র ২৮ জন। আর আত্মহত্যার চেষ্টা চালান মাত্র ৫০০ জন।
আপাত দৃষ্টিতে ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি না হলেও এ সংখ্যা কমই বা কিসে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে এসে বরং বেড়েছে। তবে আশার বাণী হচ্ছে, প্রত্যেক পরিবারে আপনজনরা আনন্দের সঙ্গে একসাথে বসবাস করলেই এ সংখ্যা আরো কমে যাবে বলে বিশ্লেষকরা অভিমত দেন।
অন্যদিকে বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। যা আগামী ২০২০ সাল নাগাদ বছরে ১৫ লাখ লোক আত্মঘাতী হবেন। আর ওই সময় ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন বলে আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে আসে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ দেশ গায়ানা। দেশটির যেখানে প্রতি লাখে ৪৪ জন আত্মহত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল জানান, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয় কীটনাশক খেয়ে। বাকিটা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পাশের দেশ ভারতেও একই চিত্র দেখা যায়। প্রেমঘটিত কারণে এ সংখ্যাটা অনেক বেশি। পারিবারিক কলহের কারণেও অনেক বেশি আত্মহত্যা হচ্ছে এখন। পারিবারিক শান্তি বজায় রাখলেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ছেলে মেয়েদের সমান আদর-যতœ ও আনন্দমূখর পরিবেশে বড় করে তুললে আত্মহত্যার প্রতিরোধ সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেহতাব খানব রাইজিংবিডিকে জানান, নিজের জীবনকে উপভোগ করতে হবে। কোনো পিছুটান রাখা যাবে না। জীবনের দাম অনেক বেশি। এটা একান্তই নিজের উপভোগের জন্য। কোনো তুচ্ছ কারণে নিজের জীবনটাকে শেষ করার দরকার নেই। এরকম মনোভাব নিয়ে যারা সংসার কাজকর্ম করছেন তারা এরকম ভয়ঙ্কর কাজ করেন না। আমাদের দেশে আত্মহত্যার জন্য উৎসাহিত করা হয়। যা ঠিক নয়। মিডিয়াসহ সকল সচেতন মহলকে আত্মহত্যার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
মন্তব্য চালু নেই