আত্মবিশ্বাসী কেন্দ্র সংশয়ে তৃণমূল
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত আগাম নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির চলমান আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এ পর্যন্ত ৯টি জেলা সফর করেছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ সব জনসভায় প্রত্যাশার চেয়েও সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে দলটির হাইকমান্ডকে।
তবে এ সব সফরে বিপুল জনসমাগম কেন্দ্রে স্বস্তি দিলেও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সংশয়ে রয়েছেন। ভবিষ্যতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে অতীতের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা সে বিষয়টিই এখন তাদের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক এবং তৃনমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য মিলেছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ধারাবাহিক কঠোর আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিকে প্রাধান্য দিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চাইছে বিএনপি। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অবৈধ’ এবং ‘অনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে সংলাপের দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিলেও কার্যত আন্দোলন থেকে দূরে রয়েছে দলটি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিলেও আন্দোলনের ডাক দেননি।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মূলত হতাশ তৃনমূলকে জাগিয়ে তোলা, সাংগঠনিক পূনর্গঠন এবং পুনরায় আন্দোলনের নামার আগে সাধারণ মানুষের সমর্থন জানার জন্য দেশব্যাপী সফরের সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি প্রধান। একই সঙ্গে সফরগুলো বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে সৃষ্ট অন্তর্কলহ মেটাতে সহায়ক হবে বলেও মনে করে দলটির হাইকমনান্ড। এর অংশ হিসেবে নির্বচানের পর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত রাজবাড়ী, মুন্সিগঞ্জ, জয়পুরহাট, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া, জামালপুর, নীলফামারী, নাটোর, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা-এই ৯টি জেলা সফর করেছেন খালেদা জিয়া। ফেনী ও চট্টগ্রামে আরো দুটি জনসভার করার কথা রয়েছে খুব শিগগিরই।
এসব জেলায় প্রত্যাশার চেয়েও বিপুল সংখ্যক উপস্থিতি স্বস্তি ফিরেছে বিএনপিতে। দলীয় প্রধানের সফরকে কেন্দ্র করে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। তারা বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে টানা আন্দোলনে কোনো প্রত্যাশিত ফল না আশায় তাদের মনোবলে চিড় ধরেছিল। এই ধরনের সফরে নতুন করে উৎসাহ পাচ্ছেন তারা।
ধারাবাহিক সফরের অংশ হিসেবে সর্বশেষ কুমিল্লায় জনসভা করেন খালেদা জিয়া। ওই সফরে ব্যাপক জনসমাগম ঘটে। স্থানীয় টাউন হল মাঠ ছাপিয়ে সমাবেশের পরিধি আশপাশের এলাকাগুলোতেও বিস্তৃত হয়। পাশের প্রায় ৬টি জেলা থেকেও নেতাকর্মী-সমর্থকরা জনসভায় যোগ দেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, কুমিল্লা বিএনপির প্রায় সব শীর্ষ নেতাদের নামেই মামলা রয়েছে। এরপরও বিপুল সংখ্যক উপস্থিতি প্রমান করে মানুষ বিএনপির সঙ্গে আছে। তারা জানান, স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা দ্রুত আন্দোলন চান। কারন আন্দোলনের না থেকেও তাদের নামে বিভিন্নভাবে একের পর এক মামলা হচ্ছে। এসব মামলা মোকাবেলা করেই তারা কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। তাই আন্দোলনে দীর্ঘসূত্রিতা ঘটলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা তৈরি হবে।
যেমনটি বলছিলেন কুমিল্লা জেলা দক্ষিন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন। তিনি বলেন, সারাদেশের আন্দোলনের চেয়ে ঢাকার আন্দোলন মূখ্য ভূমিকা পালন করবে। সেজন্য ঢাকায় যদি আন্দোলন না হয়, দেশের অন্য জায়গার আন্দোলনে সেভাবে আউটপুট পাওয়া যাবে না। ঢাকার জোরদার আন্দোলন হলে স্থানীয় আন্দোলনের গতি আরো বাড়বে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আন্দোলনের জন্য মানুষ তীর্থের কাকের মতো বসে আছে। তারা হয় অধিকার আদায় করবে, না হয় মৃত্যুর জন্য নিজেকে সপে দেবে। বেঁচে থাকা অর্থহীন। মানুষ জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে নামবে। গুলি-বন্দুক দিয়ে আন্দোলন ঠেকানো যাবেনা। মানুষ মনের দিক থেকে এই সরকারকে ঘৃনা করে।’
ইয়াসিন বিশ্বাস মনে করেন, এমন সময় আসবে যখন ঢাকায় আন্দোলন না হলেও জনগণের প্রতিবাদের মুখে ঢাকা সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন ঢাকার আন্দোলন হলো, কি হলোনা তাতে খুব একটা যাবে-আসবে না সাধারণ মানুষের। আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে নেতাকর্মীদের নামে প্রতিনিয়িত মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমুলক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এইসব মামলা দিয়ে মানুষের মনকে বেধে রাখা যাবেনা। মিথ্যা সব সময়ই মিথ্যা। এটা প্রমান হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির জেলা সফরগুলোতে বিপুল জনসমাগম শুধু বিএনপির পক্ষেই সমর্থনই প্রমান করেনা, বরং সরকারের প্রতি তাদের অসন্তুষ্টিরও জবাব। এটি সরকারের বোঝা উচিত। যদি না বোঝে, তবে জনগণকে নিয়ে সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে সেটি বোঝানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা।
বিএনপির আন্দোলনের পক্ষে জনগণের সমর্থন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এই সমর্থন ভবিষ্যত আন্দোলনের ক্ষেত্রে উৎসাহ যোগাবে।
তবে ঢাকার আন্দোলন নিয়ে তৃনমূলের হতাশার প্রমান পাওয়া যায় নাটোর জনসভায়। ওই জনসভায় আন্দোলন সম্পর্কে জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ঢাকার নেতাদের ব্যর্থতা তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সামনেই বলেন, ‘গতবার ঢাকায় আন্দোলন হয়নি, তারা ব্যর্থ হয়েছে। এবার যদি ঢাকায় আন্দোলন সফল করতে না পারে আমরা নাটোরবাসী ঢাকা ঘেরাও করব। কেবল আপনি অনুমতি দিলেই তা হবে।’
এদিকে খালেদা জিয়ার জেলা সফরের পাশাপাশি দলের সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে ৪০টির বেশি টিম ইতিমধ্যে তৃণমূল ঘুরে এসেছেন। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা সফর করেন। তৃণমূলের কোন্দল, সাংগঠনিক দুর্বলতা, ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কৌশলসহ নানা বিষয়ে তাদের মতামত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তৃণমূলের মতামত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অবহিত করা হয়েছে। তবে তৃনমূল নেতারা মনে করেন, আন্দোলনের ডাক দিলে বিএনপির মাঠপর্যায়ে আগের মতোই আন্দোলন হবে। তাদের ভয় কেন্দ্র নিয়ে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা ও জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন এমন একজন নেতা বলেন, বিএনপির পায়ে ব্যাথা কিন্তু চিকিৎসা চলে মাথায়। এই ধারনা থেকে সরে আসতে হবে। আন্দোলনের আগে জেলা ইউনিটগুলোর চেয়ে ঢাকাকে সর্বোচ্চ উপযোগী করে গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। যেভাবে ঢাকা মহানগর বিএনপি এগোচ্ছে বা নতুন কমিটি হচ্ছে; তাতে কোন্দল আরো বাড়ছে।
ঢাকার আন্দোলন নিয়ে তুনমূলে অস্বস্তি আছে স্বীকার করে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকার আন্দোলন নিয়ে নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিলো। ঢাকার বাইরে ব্যাপক আন্দোলন হলেও ঢাকায় জমানো সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে পুলিশেরও মারাত্মক ভূমিকা ছিলো।
তবে ভবিষ্যত সরকার বিরোধী আন্দোলনে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্ব কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলেও মনে করেন দলের জেষ্ঠ্য এই নেতা। তিনি বলেন, এবার ঢাকায় আন্দোলন হবে। মির্জা আব্বাস অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটির পূনর্গঠনের কাজও প্রায় শেষের পথে নিয়ে এসেছেন তিনি। তার (মির্জা আব্বাস) নেতৃত্বে বিএনপির আন্দোলন সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জনগণের কাছে যাচ্ছেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মামলার বোঝা মাথায় নিয়েও যেভাবে সাড়া দিচ্ছেন তা কল্পনাতীত। এটি সরকারের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা। সূত্র : রাইজিংবিডি
মন্তব্য চালু নেই